Ticker

50/recent/ticker-posts

বুক রিভিইউ: প্রদোষে প্রাকৃতজন

লিখেছেন: ইমাম আবু হানিফা


ছোটবেলা ইতিহাসের বইতে পড়েছিলাম ১২০৫-৬ সালে তুর্কি সেনাপতি ইখতয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি নদীয়া আক্রমন করেন এবং মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে রাজ্য জয় করেন। রাজা লক্ষন সেন পলায়ন করেন। এটুকু প্রায় সবার জানা।

কিন্তু শুধু এটুকু জানলে কিছুই জানা হয় না। সেই সময়টা এমন এক সঙ্কটকাল, যার সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু জানি না। ছোটবেলা যত সহজে ইতিহাস পড়েছি সময়টা এত সহজ ছিলো না।
কিন্তু বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠায় কাদের সহযোগিতা ছিলো? দেশি শক্তির সাহায্য ছাড়া বিদেশি শক্তি একটি দেশ দখল করতে পারে না। কারা করলো বিশ্বাসঘাতকতা? কেন করলো? কোনো স্বার্থের লোভে নাকি নিরুপায় হয়ে?
#রিভিইউ
বইয়ের নামঃ প্রদোষে প্রাকৃতজন
লেখকঃ শওকত আলী
প্রকাশনীঃ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৯৭
জনরাঃ ঐতিহাসিক
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৪
বইয়ের নাম শুনলেই জানতে ইচ্ছা করে এর অর্থ কি! প্রদোষকাল মানে সন্ধ্যা বা অন্ধকার হওয়ার ঠিক আগের সময়। আর প্রাকৃতজন বলতে লেখক সেই সময়ের নিচু শ্রেণির মানুষদের বুঝিয়েছেন। নামকরনের মধ্যেই কিছুটা ধারনা পাওয়া যায় উপন্যাসের পটভূমির।
শ্যামাঙ্গের কথায় শুরু হয়েছিল গল্প। শ্যামাঙ্গ শিল্পী, আমাদের দেশের সেই সময়ের একান্তই নিজস্ব শিল্প, মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরির কাজ করত সে। এক মন্দিরের জন্য কাজ করার সময় সে দেবদেবীর সাথে সাথে তৈরি করে কিছু মানবমূর্তি। কিন্তু মন্দির যার টাকায় হচ্ছিল, সে এসব মেনে নেয়নি, মেনে নেননি শ্যামাঙ্গের গুরুও। গুরুর সাথে বিবাদ করে নিজ গ্রামে ফিরতে গিয়ে ভুল করে চলে আসে উজবট নামক গ্রামে। এখানেই পরিচয় হয় মায়াবতী ও লীলাবতীর সাথে। দুই সখির স্বামী থাকলেও তারা একপ্রকার স্বামীহীনা। মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাস বানিজ্য করার উদ্দেশ্যে গৃহছাড়া, লীলাবতীর স্বামী অভিমন্যুর কথা না হয় বইটা পড়াই জেনে নিবেন।
মায়াবতীর পিতৃগৃহে এক রাত অতিথি থেকে নিজ গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় শ্যামাঙ্গ। অপরদিকে বহুদিন নিরুদ্দেশ থাকার পরে বাড়ি ফিরে আসে মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাস। বসন্তদাসের ঘনঘন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাথে সাক্ষাৎ অনেকের মনেই সন্দেহ সৃষ্টি করে। অপরদিকে শ্যামাঙ্গ নিজ গ্রামে যাবার পথে রাজপুরুষ ও দস্যুদের দ্বারা সর্বস্বান্ত হয়ে আবার উজবটে ফিরে আসে। আসার পথেই সে লীলাবতীর প্রতি টান অনুভব করে। গ্রামে ফিরে আসার পরেই সামন্ত অনুচর আর যবনদের (মুসলিম) আক্রমনে ধ্বংস হয়ে যায় উজবট গ্রাম। বসন্তদাস আগেই পালিয়ে যায়। আর আক্রমনের সময় শ্যামাঙ্গের হাত ধরে পালিয়ে আসে লীলাবতী। শুরু হয় শ্যামাঙ্গ আর লীলাবতীর অন্তহীন যাত্রা।
শ্যামাঙ্গ, লীলাবতী, বসন্তদাস, মায়াবতী, অভিমন্যু সহ সকলের ভবিষ্যত তুলে রাখলাম আপনাদের জন্য।
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ কাহিনী সংক্ষেপ লেখা সহজ হলেও বইটার পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখা বেশ কঠিন একটা কাজ। ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করবো তা বোঝা মুশকিল। যদি প্রশ্ন করেন যে, এটা কি ইতিহাসের বই? তাহলে বলতে হবে, “না, এটা ইতিহাসের বই না”। ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতেও অনেকের আপত্তি থাকবে। তবে নিশ্চয়ই বইয়ের উপজীব্য ইতিহাস। এমন একটা সময়ের ইতিহাস যা নিয়ে আমাদের খুব ঘোলাটে একটা ধারণা। তবে বাংলা মুসলমানদের আগমন কিংবা আগমনের ফলে এই যে এতো সংখ্যক মানুষ ক্রমাগত মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, সেসব নিয়ে বেশ ভালো একটা ধারণা পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের যে একটা অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট কাজ করছিল সেই সময়টায়, সেটা বেশ অবাক করে দেবার মতন। দিকে দিকে রাজপুরুষদের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। বনিকদের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আর এই অত্যাচারের শিকার নিন্ম বর্ণের হিন্দু আর বৌদ্ধরা। তাদের একটা বিরাট অংশ ভাবছিল যবনদের (মুসলমান) আগমনে সামন্তদের অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটবে। অনেকেই ধর্ম কিংবা দীর্ঘদিনের বিশ্বাসের বাইরে চিন্তা করতে পারছিল না, তারা অত্যাচারিত হলেও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় দ্বারা শাসিত হতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল। আর খুব সামান্য কিছু মানুষ ছিল, যারা কি না জানত যে, শাসক বদলালেও চরিত্র বদলাবে না।
কী আছে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘–এ? একে যদি শুধু ইতিহাসআশ্রিত উপন্যাস বলি, তাহলেও সত্য হয়। তবে আংশিক। ইতিহাসে ব্রাত্যজনের কথা থাকে না। ইতিহাস শুধু মনে রাখে সফল আর জয়ীদের। যে সমাজ ও সময়ের কথা শওকত আলী তাঁর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘ উপন্যাসে লেখেন, যখন ব্যক্তির স্বাধীনতা আর অর্থনৈতিক মুক্তি দুটিই জরুরি; অথচ সমাজের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠীর শ্রম, মর্যাদা প্রতিনিয়ত লুণ্ঠিত হচ্ছে, অচ্ছুৎ সে প্রতিনিধিদের কথা তিনি বলে যান ইতিহাস সঙ্গে নিয়ে, ইতিহাসকে আভাসিত করে। মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ যখন ভাবে, ‘প্রজাকুল সুখী। ব্রাহ্মণ সুখী, কায়স্থ সুখী, বৈশ্য সুখী। কেবল ব্রাত্য শূদ্রদের গৃহে অন্ন নেই, দেহে বস্ত্র নেই, মস্তকোপরী গৃহের আচ্ছাদন থাকে না। তথাপি আজ যদি গ্রামপতি বসবাসের স্থান দিলেন তো কালই বলবেন, দূর হ, পামরের দল।’ তো এই অবস্থা বা তার চেয়েও ভয়াবহ চিরবাস্তবতার সত্যটি শওকত আলী আশ্রয় করেছেন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘-এ।
ইতিহাসের তিনটি ঘটনা-তুর্কিদের গৌড় ও বঙ্গবিজয়ের আগে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সনাতন ও ব্রাহ্মণ হিন্দুদের বিরোধ এবং রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলের একেবারে শেষ দিকে সামন্তদের নিপীড়নের মুখে প্রান্তিক মানুষের অস্তিত্ব সংকট ও একই সঙ্গে যবনদের আগমনের সময়টা চিত্রিত আছে এখানে। প্রায় ৮০০ বছর আগের ইতিহাসের সেসব চরিত্র নিয়ে উপন্যাস লেখার আগ্রহ কিভাবে এলো শওকত আলীর মনে?
এই বইটি লেখার পেছনের গল্পটি বলেছিলেন শওকত আলী। তিনি বলেন, “আমার চিন্তাটা এ কারণেই এসেছিল যে এখানকার সাধারণ মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজ্যশাসনের যে প্রক্রিয়াটা ছিল-তা তো তারা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রান্তে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা এত বেশি হওয়ার কারণ কী? এটা আমার একটা প্রশ্ন ছিল। আমি অনেকজনকে প্রশ্ন করেছি; কিন্তু কোনো সঠিক উত্তর পাইনি। মুসলমান যারা দিগ্বিজয় করতে এসেছে তারা তো ওই দিক দিয়ে এসেছে। তারপর মোগল-পাঠানরাও ওই দিক দিয়ে এসেছে। এটা কিন্তু অবাস্তব কৌতূহলের কিছু নয়। একসময় মুসলমানরা এখানে আধিপত্য করেছে, তারা শাসন করেছে ২০০-৪০০ বছর, তারা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ওই সব অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়েনি। এখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। এটা সম্পর্কে আমি অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি, বইপত্র পড়েছি। একসময় একটা সংস্কৃত বই হাতে আসে। বইটির নাম হচ্ছে শেখ শুভদয়া। কেউ বলেছে সেন রাজত্বের পরপরই ওটা লেখা হয়েছিল। শেখের শুভ উদয় এই অর্থে। শেখ মানে মুসলমান। ভালো সংস্কৃত আমি জানি না। মোটামুটি পড়তে পারি। কিন্তু হিন্দি ভালো পড়তে পারি। তো ওর মধ্যে কিছু কিছু গল্পের মতো পেয়েছি। যেমন একটা দৃশ্য ওখানে পেয়েছি যে অশ্ব বিক্রেতারা নৌকায় চড়ে অশ্ব বিক্রয় করতে এসেছে। অশ্ব বিক্রয় হয়ে গেছে। সন্ধ্যা সমাগম। তখন ছয়-সাতজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি, তিনি উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে, মানে সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে কানে হাত দিয়ে উচ্চস্বরে কাকে যেন ডাকছেন। তারপর এক জায়গায় গোল হয়ে বসে প্রভু-ভৃত্য সবাই একপাত্র থেকে আহার গ্রহণ করছেন। আহার শেষে একজন সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করছে, তারপর উবু হয়ে থাকছে, অবশেষে প্রণাম করছে। তিনি যা যা করছেন পেছনের সবাই তাঁকে অনুসরণ করছে। সামনে যে ছিলেন সে কিন্তু প্রভু নন; ভৃত্য। তবু সবাই তাঁকে অনুসরণ করছে। এ রকম একটা দৃশ্য যদি দেখে সাধারণ মানুষ, যে মন্দিরের ছায়ায় অচ্ছুত নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের পা যেন না পড়ে সে জন্য সকালে মন্দিরের পশ্চিম পাশের এবং বিকালে মন্দিরের পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়ে নিম্নবর্গীয় মানুষের চলাচল বন্ধ, তাহলে তাদের মনে প্রতিক্রিয়া কী হবে? এ রকম একটা অবস্থা সেখানে ছিল। এরপর যখন যবনরা এল, তারা একসঙ্গে বসে, একসঙ্গে ওঠে, একসঙ্গে খায়, প্রভুর উপাসনা করে। আমার নিজের মনের থেকে ধারণা হলো এ অঞ্চলে নিম্নবর্গের মানুষ সবচেয়ে বেশি ছিল এবং এখানে সবাই যবন ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এর কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ আমি দিতে পারব না। এটা আমার অনুমান। এই ভিত্তিতে আমি উপন্যাসে এই উপাদানগুলো ব্যবহার করেছি।“
মানুষ তার পরিবারে সুখি হতে চায়। একজন সাধারন মানুষের সারাদিনের কাজের কেন্দ্রে থাকে পরিবার। কিন্তু উপন্যাসে যে সময়ের কথা বলা তখন উচ্চশ্রেণির মানুষের কাছে ধুলিস্বাত হচ্ছিলো নিন্মশ্রেণির মানুষের পরিবার। ফলে বিদেশি শক্তির আগমন ছিলো সময়ের ব্যাপার।
লেখক শওকত আলীর লেখা বই এই প্রথম পড়লাম। আর বইটা পড়া অবস্থায় লেখকের মৃত্যুর খবর পেলাম। এটা খুবই বেদনাদ্বায়ক ছিলো আমার জন্য। বারবার মুগ্ধ হয়েছি তার লেখনিতে। এত চমৎকার শব্দের ব্যবহার খুব কম পেয়েছি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে। প্রথম দিকে কাটখোট্টা মনে হলেও পরে সেটাকেই সাবলীল মনে হয়েছে। টাইমলাইনের সাথে মিল রেখে ভাষার ব্যবহার বইটাকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা। বইটা পড়ার পরে আমাদের দেশের পাঠকদের নিয়ে আহসোস হচ্ছে। আমরা গুটিকয়েক লেখকদের নিয়েই মাতামাতি করি। অনেককে পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের বই পড়ে দেশি লেখকদের মুন্ডুপাত করতে দেখি। অথচ শওকত আলীর মত আরো অগণিত লেখকদের নিয়ে চর্চা করি না।
সবশেষে লেখকের জন্য প্রার্থনা করি, সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে ওপারে শান্তি দেন!

Post a Comment

2 Comments

  1. এই জন্যই বইটা আমার কাছে এত ভালো লেগেছে। ইতিহাসের পেছনের যে ইতিহাস (নিম্ন বর্গের ইতিহাস) তা এই বইয়ে উঠে এসেছে। লিখিত ইতিহাসের ফাক-ফোকরে যে আসল ইতিহাস লুকিয়ে থাকে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক শওকত আলী।

    ReplyDelete
    Replies
    1. জনাব সেনরা এদেশের ছিলেন না।

      Delete