Ad Code

Responsive Advertisement

বুক রিভিইউ: পুতুল নাচের ইতিকথা -মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা

লিখেছেন: ইফতেখার মাহমুদ
------------------


কিছু কিছু লেখা রয়েছে পড়া শেষে মন-মনন-সব দূরে কোথাও লীন হয়ে থাকে। আচ্ছন্নতা আসে লেখকের কথা
ভাবতে ভাবতে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও কি বিশ্বাস করে বসেছিলেন গাওদিয়া গ্রাম আছে – সেখানে শশী-কুসুম-মতি-পরান–গোপাল- সবাই সত্যি সত্যি আছে! কি অনির্বচনীয় এক শূন্যতাবোধ অকথ্য ভালবাসায় জড়িয়ে রেখেছিল তার হৃদয়-অন্তর-বুদ্ধি! মহৎ লেখকই এমন ব্যথাময়তায় পুরোপুরি সঁপে দেয় হয়ত।
নাম দিয়েছেন পুতুল নাচের ইতিকথা। পুতুলকে যে নাচায় কেন যে নাচায়, জানে কি সে? জানেনা পুতলও। তবুও জীবন চালিয়ে যেতে হয়। কুসুমের বাবা বলে ওঠেন ‘সংসারে মানুষ চায় এক আর হয় আর ... । পুতুল বৈ তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন...’। নিয়তিবাদের সাথে লড়াই শুরু হল অস্তিত্ববাদের। আমি আছি তাই সবকিছু আছে, কর্মই তো জীবনের উদ্দেশ্য, এবং উদযাপনের পন্থাও। ডাক্তার শশী জীবন মৃত্যুর লড়াইদৃশ্যে বারবার হেরে যাচ্ছেন, কিন্তু থেমে যেতে পারছেন না। একবার মৃত্যুর কাছে হেরে যাওয়া ডাক্তার কি পরেরবার আবার মৃত্যুবধে নামেন না? ডাক্তার শশী কি থেমে যেতে পারে? আমরা কি থেমে যাই? যাওয়া যায়? উপন্যাসজুড়ে একটির পর আরেকটি মৃত্যু! কতকিছুই ডাক্তার শশী করে ফেলতে চেয়েছিল ! অজস্র অপারগতার মাঝে এক অতৃপ্ত মানবজীবন শেষমেশ হাতে আগলে অসহায় রয়ে যায় শশী।

কুসুম অন্যের ঘরবধু হয়েও ডাক্তার শশীকে ভালবেসে ফেলা একটি মেয়ে। স্বামী পরানকে ছেড়ে শশীকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার স্বপ্নে ভোর তার মন। শশী ততটাই শীতল। মর্মান্তিক উদাসীনতায় বলা তার সেই কথাটি – ‘তোমার মন নাই কুসুম !’, সংশয়াচ্ছন্ন শশীর রূপ যেমন প্রকাশ করে দেয়, তেমনি ইঙ্গিত দেয় এই সম্পর্কের পরিনতির। বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে রওয়া শব্দকয়টি কত কিছুরই না উৎস মুখ খুলে দেয়।

শশীর বন্ধু কুমুদ হলো উপন্যাসের চমক। বই পড়া ছেলে, অভিনেতা হয়ে নাট্যদলের সাথে এ গ্রাম সে গ্রাম করছে। জড়ায় না। খুলে খুলে ফেলে। তীব্র। বজ্রসম। বিভাময় দ্যুতি, তবে পথ দেখানোর আলো এ নয়। হতে চাওয়ার মত হলো কুমুদ, আর হতে না পারার মত হলো শশী। কুমুদও কেউ হত না জীবন নাটকে, যদি না মতি নামের মেয়েটির আশ্চর্য-হৃদয়তোলপাড়-করা তুমুল–তীব্র প্রেম না থাকত । মতিই কুমুদকে করেছে প্রার্থনীয়, আকাঙ্ক্ষার্হ। প্রেম যে সমকালীন সবকালীন মতিকে দেখে বারবার মনে হয়েছে তা। “কুমুদ যখন বই পড়ে, কাজের ফাঁকে বারবার তার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে পারিয়াই কত সুখ হয় মতির; কুমুদ যখন বাহিরে থাকে তখন দেখে মনে হয় অকারণে কি এক অভিনব পুলকপ্রবাহ অবিরাম বহিয়া যায়...” । আহারে প্রেম – কি সবল , কি সরল ! রবীন্দ্রনাথের মতো – অনুভবে এবং প্রকাশে । মতির মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৃশ্যে সুধা ছড়ানো রয়েছে- কি অপূর্ব সুখকণা বয়ে চলেছে মতি নামের কিশোরী মেয়েটির চেতনাজুড়ে। প্রেম। কুমুদ তার জীবনাচরণ নিয়ে অর্থবহ হয়ে থাকে গল্পশেষেও – অশেষে নিঃশেষ ।

কয়েকবার হুমায়ূন আহমেদকে মনে পড়ে যায়। গল্প রীতিতে হুমায়ূন আহমেদ মানিক দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে মনে হয়। প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির নিয়মে নীচ সারিতে তীব্রতা বেশি – মানিক তা ভালবেসেছেন আমরা আজ তা জানি। হুমায়ূন ও তাই নন কি। প্রথমদিকের লেখাগুলো শহুরে বটে- কিন্তু তা অর্থকষ্টজর্জরিত নিম্নবিত্তেরই তো গল্প! মতির মত কিশোরী হুমায়ূনের লেখায় প্রায় প্রায়ই দেখা যায়। 
আর একটা মিল । দুজনই কবির মত করে ‘মমতা’ শব্দটা ব্যবহার করেন। ভালবাসা নয়, প্রেম নয় – শব্দটি মমতা। কত জায়গায় যে মানিক লিখেছেন – ‘কুসুমের মমতা’, ‘শশীর মন মমতায় ভরে যায়’, ‘মতির মমতা’। হুমায়ূনেও আধিক্য আছে এই শব্দটির। অনেক গল্পে। ‘মমতা মাখা চোখ’, ‘মমতার হাত ফিরিয়ে দিই নি...’ ইত্যাদি অনেকবার অনেকখানে। প্রেম শব্দটি কিন্তু নেই (অথবা কম আছে, বলা যাক) দুজনেরই । 
আরেকটা অংশ খুবই কৌতূহলোদ্দীপক – মতি আর কুসুমের গল্প থামিয়ে দিয়ে মানিক লিখছেন ‘পুতুল নাচের ইতিকথায় সে কাহিনী প্রক্ষিপ্ত – তাদের কথা এখানেই শেষ হইল’। হুমায়ূন আহমেদের ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসে সুপ্রভার মৃত্যুর পর (আত্মহত্যার) লেখক লিখছেন তোমার কথা শেষ এখানেই, অপেক্ষা উপন্যাসে কেউ আর তোমার জন্য অপেক্ষা করবে না। ভঙ্গিটি কি এক নয়?

মানিক বন্দ্যোপাধায়ের ভাষারীতি ও বিশেষণ-নির্বাচন বিশেষ লক্ষণীয়। মানিক লিখছেন ‘চিন্ময় জগতটি চোখের পলকে লুপ্ত’। চিন্ময় জগত! আরেক জায়গায় লিখছেন ‘আকাশের এক প্রান্তে ভীরু লজ্জার মতো একটু রঙের আভাস’। কাব্যিক এবং রহস্যময়। আরও কিছু উল্লেখ করা যাক –

‘বিকেলের দিকে এখানে প্রত্যহ সরকারি আড্ডা বসে’। (সরকারি কি বারোয়ারি অর্থে? নাকি নিরর্থক অর্থে নাকি নিয়ম অর্থে ?)

'সকাল বেলা রাত-জাগা-চোখে মতিকে যেন বয়সের চেয়ে অনেক বড় মনে হইতে লাগিল।' (রাত জাগা চোখ কিন্তু লাল চোখ নয় শুধু, মানিক ইংগিত করছেন বুদ্ধি বা বিবেচনাবোধের উপর রাতে না ঘুমানোর প্রভাবের কথা। চোখের কথা এটি নয়, দৃষ্টি এবং দ্রষ্টব্যের সমন্বয়ের ঘাটতির কথা এটি।)

'আনন্দে সে ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলিতেছে।' (কি বিহ্বলতা! চঞ্চল মুখখানা দেখা যায় যেন !)

'চুলে অন্যমনস্ক বিদ্রোহ নাই।' 'তাহাকেই মাকড়ি দিতে চাওয়ার জন্য প্রবীর কি ভয়ানক ভাল !' ' ... এমন অনির্বচনীয় অসহ্য পুলক তো জাগিত না ...' (ভয়ানক ভাল, অসহ্য পুল্‌ক, অন্যমনস্ক বিদ্রোহ - আধুনিকসব কথাভঙ্গি। )

কুসুম তাহার লিভারটা দেখাইয়া দিল (সাপের কামড় নিয়ে কুমুদের সাথের কথোপকথনের সময়; মনে রাখা চাই - ১৯৩৬ সালের উপন্যাসে বাংলা ভাষার এক ঔপন্যাসিক এটা লিখছেন। যে দেখিয়ে দিচ্ছে সে লিভারের অবস্থান জানেনা সত্য, কিন্তু শুননেওয়ালা ডাক্তার ! পাঠককে স্পষ্ট ধারণা দেয়ার এর চে ভাল আর কি উপায় আছে! যেন দেখা যাচ্ছে !)

মোটরে চাপিয়া কলিকাতা শহর গাওদিয়ার দিকে চলিয়া গেল। (কবিতাই তো !)

আকাশে রবির তেজ কমিয়াছে। মাঠে রবিশস্য সতেজ। (বাক্য গড়ন ! )

'এইটুকু বয়সে এমন উপভোগ্য মন-কেমন-করা' ! কিংবা 'গ্রামের মেয়ে তো, নিশ্চিন্ত থাকিবার বয়স ইতিমধ্যে পার হইয়া ... ' ( ভাষার আধুনিকতা লক্ষনীয় )

'জীবন অপেক্ষা যাহা তার প্রিয়..' 'খুঁজিলে এমন কিছুও পাওয়া যায় জগতে, বাঁচিয়া থাকার চেয়ে যা বড় ।' (বাঁচা নয়, বাঁচার কারণটাই বড় !)

'বর্ষার মতো বিষণ্ণতা ঘনাইয়া আসে ... ' ; 'সময়ের সব সময়েই অভাব' (অনুপ্রাস!)


উপন্যাসটির আরেকটি দিক হল - গল্পে সময় বদলে যাওয়া শুধু ঋতু বদল দিয়ে হচ্ছে না; রোগের পরিবর্তন দিয়েও সময় আর পরিবেশ বদলে যাচ্ছে । শীত আসছে, বর্ষা যাচ্ছে-আসছে, আবার গ্রীষ্ম – আর সাথে সাথে রোগ বদলাচ্ছে ! গল্পে প্রোটাগনিস্ট একজন ডাক্তার, এই কায়দাটিকে মুন্সিয়ানাই বলব।

দু একটা অসংগতি চোখে পড়ল – কুসুমের বাবার নাম একবার পাচ্ছি ভুবনেশ্বর (৫ম অধ্যায়ে), আরেকবার নাম লেখা হল অনন্ত (১২শ অধ্যায়ে) – এরকম নতুন নামে আবির্ভাবের কারণ কি? 
আরেকটি খটকা – সম্ভবত অত গুরুত্বপূর্ণ নয়... তবে ভুলটা কে করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি প্রকাশক ? উপন্যাসে কুসুম একদিন ভোরে শশীকে ডেকে তালবনে নিয়ে যায় বিন্দুর কথা শুনাবার জন্য, অথচ উপন্যাসের শেষে (১২শ অধ্যায়ে) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, শশী ডাক্তারের আফসোসের কথা – ‘ মতি আর কুমুদের ব্যাপারটা শুনিবার জন্য একদিন কত ভোরে কুসুম তাহাকে তালবনে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিল, এত বড় উপলক্ষ পাইয়াও কুসুম কি তার পুনরাভিনয় করিতে পারিত না?’ পরের অধ্যায়েও একই প্রসঙ্গে আরেকটা অসংগতি আছে- ‘.. কুসুম যেখানে বসিয়া মতির কথা শুনিয়াছিল ...’ – আসলে শুনেছিল বিন্দুর কথা। আশা করছি এগুলো বহু পূর্বে সনাক্তকৃত ছাপার ভুল বৈ অন্য কিছু নয়। লেখকের ভুলও হতে পারে কি? কোন গবেষক কি মমতা আর যত্ন নিয়ে উপন্যাসটির এই দিকটি বিশ্লেষণ করেছেন?

শশীর বাবা গোপাল ও শশীর সম্পর্ক এই উপন্যাসের আরেকটি সূক্ষ্ম প্রসঙ্গ। রুচি আর বিদ্যায় বদলে যাওয়া সন্তান বাবাকে হীনতর মানুষ হিসেবেই দেখবে- এই সত্য অকপটে চিত্রিত হয়েছে। একটু বেশীই রূঢ়, একটু কঠোরও হয়ত বেশী শশী – কিন্তু তা গভীর অভিমানের- যার কারণ আত্মপরিচয়ে মিশে থাকা ক্লেদময় অতীতের অস্তিত্বের। বাবা-পুত্রের বাইরে এসে এ এক শ্রেণী দ্বন্দ্বও বটে।

শেষে বলতে চাই , ভীষণ যত্ন করে লেখা, গভীর নিপুণতায় ধীরে ধীরে নির্মোহ ভাবে গড়ে তোলা ; বুদ্ধি আর আবেগ একাকার হয়ে মিশে চলা – একদল মানুষের এই জীবনালেখ্য অভূতপূর্ব মহিমা নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়। পাঠশেষে নতজানু পাঠক জীবনকে আলিঙ্গন করে নিবিড় ভাবে - গভীর আবেশে, ভালবেসে।

Post a Comment

0 Comments

Close Menu