বই রিভিউঃ পার্থিব/শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সুতোকে সাথে নিয়ে কাঁথার গায়ে অনবদ্য ছন্দে এগিয়ে চলে সুঁই; আপাত উদ্দেশ্যহীনভাবে কখনো উপরে, কখনো নিচে, কখনো ডানে, কখনো বামে মোড় নিয়ে । চলার সময় বোঝা না গেলেও একেবেকে এগিয়ে চলা শেষ হলে কাঁথার গায়ে ফুটে ওঠে অপূর্ব নকশা ।
আমার একই অনুভূতি হচ্ছিল “পার্থিব” বইটা পড়তে গিয়ে ।
সুঁইয়ের সাথে আমি গল্পে প্রবেশ করি বিষ্ণুপদের হাত ধরে । এরপর গল্পের সাথে এগিয়ে যেতে থাকলাম একেবেকে আপাত গন্তব্যহীন পথে ।
দারিদ্র্য আর অনাহারের সাথে অবিরত যুদ্ধ করে ক্লান্ত বৃদ্ধ বিষ্ণুপদ সারাদিন তাকিয়ে থাকে মেজ ছেলে রামজীবনের অসমাপ্ত বাড়ির দিকে । অসমাপ্ত বাড়িটার ইট পাথরের দুঃখ যেন বুঝতে পারে সে । তার বড় ছেলে কৃষ্ণজীবন আজ বিশ্বখ্যাত পন্ডিত কিন্তু স্ত্রীর তীব্র আপত্তির কারণে যে দরিদ্র পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে না । মেজ ছেলে রামজীবন বড় ভাইয়ের সাথে জেদ করেই যেন পাকা বাড়ি তোলা শুরু করে বাবা-মাকে শেষ বয়সে রাখাবে বলে । জেদের বশবর্তী হয়ে টাকা উপার্জন করতে যেয়ে ডাকাতি থেকে শুরু করে অনেক খারাপ কাজে জড়িয়ে পরে সে । সেজ ছেলে বামাচরণ অর্থলোভী । আর এক ছেলে শিবচরণ বাড়িছাড়া হয়েছে অনেক আগেই । মেয়ে বীনাপানি রোজগারহীন স্বামীর সাথে অনাহারে দিন পার করতে করতে লাজলজ্জা ভুলে নেমেছে যাত্রায় ।
শীর্ষেন্দুর অন্য উপন্যাসগুলোর মত করে এই পরিবারের গল্পের সমান্তরালে উঠে আসে আরও কটি পরিবার, আরও কটি মানুষের গল্প ।
উচ্চবিত্ত হেমাঙ্গ খেয়ালী, তার পিসতুতো দিদি চারুশীলার ভাষায় পাগলাটে । চারুশীলার লক্ষ্য ভাইকে বিয়ে দেয়া । উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চাভিলাষী রশ্মি’কে চারুশীলার বড্ড পছন্দ । কিন্তু রশ্মির শর্ত, বিয়ের পর তার সাথে ইংল্যান্ডে থাকতে হবে । হেমাঙ্গের সামনে এসে দাঁড়ায় শিকড় ছেড়ার প্রশ্ন । নিজেকে বারবার প্রশ্ন করে সে- আসলেই কি সে ভালোবাসে রশ্মিকে ?
উচ্চ মধ্যবিত্ত মনীশ সারা জীবন হৈ-হুল্লোড় করে কাটালেও হার্ট অ্যাটাকের পর তাকে ঘিরে ধরে মৃত্যুভয় । বাস্তবতার স্রোতে তার পরিবারের সামনে তাকে হারাবার ভয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় । মনীশ নিজেও তা উপলব্ধি করে নিজের ভেতরে । নিজের খেয়ালীপনাকে গুটিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে পরিবারকে গোছানোর কাজে ।
এপিলেপসির রোগী নিম্ন মধ্যবিত্ত চয়ন অসুস্থ মাকে নিয়ে আশ্রিতের মত পড়ে থাকে দাদা অয়নের বাসায় । তার ভিতরের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিয়েছে এপিলেপ্সি; প্রতিক্ষণে তাকে ঘিরে ধরে হাজারো আশঙ্কা । দাদা-বৌদির শত অবহেলা আর অত্যাচারের পরও বাড়িছাড়া হবার ভয় তাকে তাড়া করে ফেরে সবসময় । তার পাশে এসে দাঁড়ায় অনিন্দিতা । পারবে কি চয়ন অনিন্দিতা-কে ধরে শক্ত হয়ে দাড়াতে নাকি সেও হারিয়ে যাবে তার জীবনের অন্য আর দশটা অপ্রাপ্তির মতই ।
এমনি করে নানা উত্থান পতনের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলে কিছু জীবনের গল্প । আমিও সুঁইকে অনুসৃত সুতাকে ধরে এগিয়ে চলি এক অনবদ্য গল্প-নদীর পাড় ঘেষে । পুরোটা সময় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকি শীর্ষেন্দুর যাদুকরি বর্নণায় ।
বইপোকার গত আড্ডায় রেযা রিফাতের তোলা প্রসঙ্গটি ছিল – “বইপোকার বেশীর ভাগ রিভিউ যেন মুগ্ধ পাঠকের বয়ান । সমালোচনা বা দূর্বল দিকের আলোচনা তাতে খুব কমই থাকে”। আমার কাছে বেশ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল রেযার কথাটা । তাই এবার পার্থিবের রিভিউ লিখতে গিয়ে আলাদা করে লিখছি আমার দৃষ্টিতে উপন্যাসটির দূর্বল কিছু দিক ।
# শীর্ষেন্দুর অন্য উপন্যাসগুলোর বেশ কিছু ছোট ছোট গল্পের এবং চরিত্রের পুনরাবৃত্তি যেন এখানেও পেলাম । মাকে নিয়ে দাদার বাসায় আশ্রিত চয়নের গল্পের সাথে আমি মিল পেয়েছি যাও পাখী’র সোমেনের ঘটনার । চয়নের মাঝে দিয়ে সোমেনের চরিত্রও যেন পুনরাবৃত্ত হয়েছে ।
# দীর্ঘ সময় নিয়ে লেখা উপন্যাস আর অনেক দিন ধরে পত্রিকায় কিস্তিতে প্রকাশিত উপন্যাসের মাঝে বেশ কিছু পার্থক্য থাকে যা এখানে প্রবলভাবে উপস্থিত । হুমায়ুনের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম, পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাসের বেলা এমনও সময় এসেছিল- যখন পাশের রুমে বসে আছে সম্পাদক আর এই রুমে তিনি লিখে চলেছেন পরের এপিসোড । পার্থিবের ক্ষেত্রে কিছু কিছু জায়গায় যেন এমন তাড়াহুড়ো’র ছাপ দেখতে পেলাম ।
# অনেক ক্ষেত্রে চরিত্র-কে পাঠকের পছন্দ বিবেচনা করে নির্মাণ করা হয়েছে । মানবজমিনে যেমন স্বাভাবিকতার সাথে বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে, পার্থিবে কিছু ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত । যাত্রায় নেমেও বীনাপানিকে সকল বাস্তবতার গ্লানি থেকে রক্ষা তেমনি একটি প্রচেষ্টা ।
# উপন্যাসের শেষে যেন সব মিলিয়ে সুখী সুখী একটা আবহ তৈরীর চেষ্টা ছিল । সারাজীবন ধরে বয়ে চলা সমস্যাগুলোর সমাধান করে “অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল”- টাইপ মত সুখী সমাপ্তিতে সবাই পৌছে যায়, যেটাকে কৃত্রিম মনে হয়েছে আমার কাছে ।
এটুকু লিখতেই আমার কলম আটকে যাচ্ছে । আসলে শীর্ষেন্দু এত বড় মাপের একজন ঔপন্যাসিক, তার লেখার মাঝে দূর্বলতা খুঁজতে যাওয়া মোটামুটি ঔদ্ধত্যের ব্যাপার- অন্তত আমার মত অতি সাধারণ পাঠকের জন্য ।
মহাকাব্য বলবো না, কালজয়ী বলতেও কিছু জায়গায় আটকাবে, তারপরও পার্থিব আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবে বাংলা সাহিত্যে (আমার ব্যক্তিগত মতামত ) । উপন্যাসটা কেন ভালো লাগে ? এর উত্তর আমি এখনো খুঁজে চলেছি । বোধকরি পাঠকের আটপৌরে জীবনের সাথে মিল, অত্যন্ত সারল্যের সাথে বলা গল্প এর প্রধান কারণ । এত বিশাল ক্যানভাসে এতগুলো চরিত্রের চিত্রায়ণ, তাদের মাঝে ঘটনা পরম্পরায় আন্তঃযোগাযোগ স্বাভাবিকভাবে ফুটিয়ে তোলা বড় সহজ ব্যাপার নয় । এর মাহাত্ম্য আরও বেশী করে ফুটে ওঠে লেখকের গল্প বলার মুন্সীয়ানায় । আমি বইটি পড়তে যেয়ে কোন বিরতি দিতে পারিনি, অনেক বড় আয়তনের উপন্যাসের বেলায় যেটা খুবই অস্বাভাবিক। বিরতিহীন এই যাত্রার শেষে যে কোন পাঠক আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন সদ্য শেষ করা কাহিনী আর চরিত্রগুলোর মাঝে ।
লেখার মুন্সীয়ানা বোঝাতে কিছু কিছু লাইন তুলে দিচ্ছি বইটি থেকে –
"ভুত হয়ে যদি থাকা যায় তো সেটাও মস্ত কথা । থাকাটাই তো আসল কথা- ভুত হয়েই হোক আর মানুষ হয়েই হোক ।"
"মৃত্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । নিত্যনৈমিত্তিক, তবু প্রতিটি মৃত্যুই মানুষকে কিছু বলতে চায় । কোনও এক সত্যের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে চুপ করে থাকে । মৃত্যুর কোনও উচ্চারণ নেই তবু অস্ফুট কিছু নীরবে বলেও যায় ।"
"প্রিয়জন মারা গেলে প্রথমটায় শুধু তার অভাবের জন্য হাহাকার হতে থাকে । কিন্তু সেই কষ্টটা বেশীক্ষণ থাকে না । তাপরে আসে অবশ্যম্ভাবী হিসেব নিকেশ । আমাদের জন্য লোকটা কতখানি রেখে গেল, আমাদের কতটা নিয়ে গেল । তখন শুরু হয় লোকটার বিচার ।"
"মানুষের পালানোর সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো তার মন । যদি সেখানে ঢুকে কপাট বন্ধ করে দিতে পারিস, তা হলে আর কেউ তোর নাগাল পাবে না ।"
"চোখে দেখে কি সুখ ? বরং ভাবলে সুখ হয় একটু । সবই ভাবের জিনিস । নইলে কার মাটি, কার জমি, কার বসত ? এগুলো কিছু না । দেশে (দেশ বিভাগের আগে বাংলাদেশে) কি খুব সুখে ছিলাম রে বাবা ? খেয়েছি তো সেই কচু ঘেঁচু, বাস করেছি মাটির ভিটির ঘরে । তবু লোকের কেবল মনে হয় দেশে কত সুখে ছিলাম । ওটা হলো ভাবের সুখ ।"
"পুরুষ মানুষের মধ্যে যা আছে, মেয়ে মানুষের মধ্যে তা নেই । আবার মেয়ে মানুষের মধ্যেও এমন কিছু আছে, যা পুরুষের নেই । হরে দরে দু পক্ষই সমান । যিনি মানুষ তৈরী করেছেন, তিনি তো আর আহাম্মক নন, একচোখাও নন । সমান সমানই দিয়েছেন দু'জনকে, তবে রকমটা আলাদা ।"
"ব্যক্তিত্ত্বহীন হওয়ার অসুবিধে অনেক আছে, আবার সুবিধেও কি আর কিছু নেই ! ব্যক্তিত্ত্বহীন মানুষদের সঙ্গ বেশীরভাগ মানুষই পছন্দ করে । কেননা তারা সব কথাতেই সায় দেয়, অকারণে অন্যায্য প্রশংসা করে এবং হাবিজাবি কথাও মন দিয়ে শোনে । মানুষ নিজের ইচ্ছেমত চালানোর জন্য এসব লোককে সবসময়ই সঙ্গী হিসেবে চায় । মানুষের ইচ্ছেপূরণে সাহায্য করে বলেই কিছু দয়া ও দাক্ষিণ্য তারা পেয়ে থাকে ।"
কোলকাতার আনন্দ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ৭১৪ পৃষ্ঠা’র বইটির গায়ে লেখা দাম ৪০০ রুপি । তার মানে আসল কপি কিনতে গেলে ৮০০ টাকা দিতে হবে । উল্লেখ্য বইটির আকার অন্য বইগুলোর চেয়ে একটু বড় । স্বাভাবিক আকৃতির হিসেবে কিন্তু পৃষ্ঠা সংখ্যা হাজারের উপরে।
যারা অনেক সরলভাবে বলে যাওয়া গল্প পড়তে ভালোবাসেন, তাদের জন্য পার্থিব । চুপি চুপি বলে যাই, তরুণ যারা উঠতি লেখক, তাদের জন্যও অবশ্যপাঠ্য পার্থিব; কিভাবে এত বড় লেখায় পাঠককে ধরে রাখতে হায়, গল্পের বুনন বুনতে হয় তার অনেক ভালো একটা উদাহরণ এই বইটি ।
0 Comments