নাম- হাবু ভুঁইমালির পুতুল,
লেখক- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়,
১৪২২ এ আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত।
রিভিইউ লিখেছেন: অন্তরাত্মার সন্ধানে
ভজং ভজং, লো পু টে' কিছু বুঝলেন? "
-আজ্ঞে না।
" ক্যম্বু ক্যাম্বু, পু টাউ', কিছু বুঝলেন?
-কিছু মাত্র না।
ভুজলহং পোটে, কিছু বুঝলেন?
-আজ্ঞে না।
আমিতো বুঝিনি।
আপনিও নিশ্চয় বোঝেন নি? আসুন তাহলে ব্যাপারটা প্রথম থেকেই শুরু করি।
কালীতলা হাটের হাড়কেপ্পন মহীধর চৌধুরীর বাড়িতে দেড়শো বছরের পুরনো দেয়ালঘড়ি অচল হয়ে পড়ে আছে। খরচ হওয়ার ভয়েই তিনি সারাই করার নাম মুখেও আনেন না। বাড়ির ঝি চাকররা আশঙ্কা করছে দেড়শো বছরের পুরনো ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে যখন, তখন এ বাড়িতে অমঙ্গল কিছু ঘটবে।
একদিন সকালে না ডাকতেই যাত্রার পার্ট করা গনশা মিস্ত্রি হিসাবে হাজির। আসল উদ্দেশ্য ছলে বলে কৌশলে ঘড়িটা হাতানো। মহীধর বাবুকে সে জানায় ঘড়িটা এক মেমের রুপ ধারন করে তার কাছে এসে কান্নাকাটি করছে। মেমসাহেবের কান্না সহ্য করতে না পেরে সে ঘড়িটা নিতে এসেছে। বাড়ি গিয়ে মেরামত করবে। অবশ্য ফ্রি সে নেবে না। নিমরাজি হওয়া মহীধর চৌধুরি যখন দরদাম ঠিক করে ফেলেছেন তখনই ভিতর বাড়ি থেকে হুকুম আসলো গনশাকে তাড়িয়ে দেবার জন্যে।
গিন্নির কথা হাইকোর্টের রায় সমান, অমান্য করার সাহস কারো নেই।
কালীতলা হাটের দক্ষিনে বটেশ্বরের ভাঙা মন্দির। একসময়ে পুজোটুজো হত। এখন সেখানে জঙ্গল এবং সাপখোপের আড্ডা এবং গাঁয়ের মানুষের ভয়ের জায়গা। অনেক বছর আগের মরা মানুষগুলো এখানে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়। রাখাল ছেলের দল, গোবর কুড়ুনি, কাঠকুড়ুনি, চোর ছ্যাচড়ারা শুধু নয়, গাঁয়ের গন্যমান্য মানুষরাও তাদের দেখা পান।
এ হেন জঙ্গলে পটল এবং গজা নামে দুজন দাবার ছক পেতে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। তাদের আলোচ্য বস্তু মহীধর বাবুর ঘড়ি। সকালবেলা গনশাকে দিয়ে টোপ ফেলে তারা সফল হয়নি। তাই তাদের এবারের প্লান তারা নিজেরাই ঘড়িটা চুরি করবে। হঠাৎ ঝোপের পাশ থেকে মানুষের হাঁচি শোনা গেল। তারা দুজনে ছাড়া এখানে কেউ নেই। তাহলে হাঁচল কে?
দানুবাবু হলেন গুণের সমুদ্দুর। একদিকে যেমন গরীবের মা-বাপ, তেমনি বড়লোকদের ঘরজামাই।
আবার চোর ডাকাতদের মাসতুতো ভাইতো খুনে গুন্ডাদের ভাইরাভাই। তার টাকার লেখাজোকা নেই। আয়ের হিসাব রাখতেই তিনজন ক্যাশিয়ার হিমসিম। চরণদাস নামের একজনকে তিনি পটল ও গনশার পিছনে আড়কাঠি হিসাবে লাগিয়েছেন। চরণদাশ ধুরন্ধর হলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল। পটল গনশার আলোচনা সে হুবহু খাতায় টুকে রাখছিল, কিন্তু গনশার কাছে ধরা পড়ায় পটল খাতাখানা পুড়িয়ে ফেলার হুকুম দেয়। দেশলাই জ্বালানোর আগ মুহুর্তে গাছের উপর থেকে হুড়মুড় করে পড়ে খাঁদু।
একঘড়ি চুরি করতে লোক লাগিয়েছেন লালবাবু। আর চোরের উপর বাটপারি করতে দানুবাবু আড়কাঠি চরণদাসকে লাগিয়েছেন ওদের ফন্দিফিকির টুকে আনতে। আবার অন্যপক্ষে চরণদাসের কাজ শেষ হলে তার খাতাখানা ছিনতাই করার জন্যে পাঁচশোটাকা কবুল করে খাঁদুকে পাঠিয়েছেন নীলকান্তবাবু।
হাবু ভুঁইমালি আধপাগল লোক। নাওয়া- খাওয়া, দিন-রাত্তির, শীত- গ্রীষ্মের কোনো বোধই তার নেই। তার সারা ঘরখানায় ছড়িয়ে রয়েছে নানান কিসিমের যন্ত্রপাতি। পুরনো তালাচাবি, অচল পাম্পসেট, বিকল টিউবওয়েল, ভাঙা ক্যামেরা, বন্ধ ঘড়ি, চাকাহীন সাইকেল, মরচেপড়া মোটর বাইক, শব্দহীন কলের গান, পুরনো রেডিয়ো, এমনকী মোটরগাড়ির ইঞ্জিন পর্যন্ত। কলকব্জার মিস্ত্রি হিসাবে একসময় তার ভালোই নামডাক ছিল। আজকাল আর কেউ তেমন হাবুর খোঁজ করে না। সে একাবোকাই তার ঘরখানায় বসে নানান যন্ত্রপাতি ঘাঁটাঘাঁটি করে। মানুষের চেয়ে যন্ত্রের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব বেশি।
গুনময় ঘোষ একদিন রাতে শুনতে পেলেন উপরোক্ত অদ্ভুত ভাষায় কেউ যেন তার সাহায্য চাইছে। ভাষার উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখলেন একটা পুতুল মাটিতে পড়ে আছে আর ক্ষীনগলায় উঃ আঃ করছে। কয়েকদিন পর পুতুলের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার পর বুঝলেন পুতুলটা একটা জরুরী কাজে এসেছে। ইশারায় গুনময়ের কাছ থেকে কাগজ পেনসিল চেয়ে নিয়ে একটা আশ্চর্য ছবি এঁকে দিল। পুরনো আমলের এক বিদেশি দেয়ালঘড়ি। যাতে সাতটা বেজে দশ মিনিট হয়ে কাটা অচল।
কি সম্পর্ক এই পুতুলের সঙ্গে ঘড়ির?
ছাতুলাল পুরনো দিনের বেশ উঁচুদরের হাতসাফাইয়ের ওস্তাদ। বদন হাওলাদার তাকে দশ হাজার টাকা দিয়েছে এই পুতুলটাকে গুনময় ঘোষের বাড়ি থেকে সরিয়ে আনতে। পাহারাহীন, খোলামেলা বাড়ির থেকে সামান্য এক পুতুল সরানোর জন্যে ছাতুলালের মতো ওস্তাদকে নিয়োগ করার মানে কি?
ছাতুলাল চুরি করতে গিয়ে এক আশ্চর্য জিনিস দেখে চোখ উল্টে ভিরমি খায়। কী সেই আশ্চর্য জিনিস?
সাতসকালেই মহীধর চৌধুরি ঘুম থেকে উঠে দেখেন অজ্ঞাতকুলশীল এক ব্যক্তি তার বৈঠকখানার পাশের ঘরে ভোঁসভোঁস করে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। মহীধর চৌধুরির গাঁইগুই সত্ত্বেও চৌধুরীবাড়িত সে স্থায়ী হয়। আস্তে আস্তে গিন্নির বিশ্বাস ভাজন হয়ে একসময় ঘড়ি সারাবার নাম করে ঘড়ি নিয়েই চম্পট দেয়।
পথে যেতে যেতে বুঝতে পারে ঘড়ির ভেতর থেকে কেউ একজন কথা বলছে। ঘড়ি খুলে দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ। কে ছিল ঘড়ির ভেতর?
পুতুলটার শেষ পর্যন্ত কি হল? ঘড়িটার সাথে কি সম্পর্ক পুতুলের? সব মানুষরা কেন ঘড়ির পিছনে পড়ল? তাদের উদ্দেশ্য কি সফল হল?
সব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে পড়তে হবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের "হাবু ভুঁইমালির পুতুল"।
নাম- হাবু ভুঁইমালির পুতুল,
লেখক- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়,
১৪২২ এ আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত।
0 Comments