Ad Code

Responsive Advertisement

বুক রিভিইউ: পুরাণ সারসংক্ষেপ

লিখেছেন: সাকু চৌধুরী 
পুরাণ সারসংক্ষেপ
=============

 ভূমিকা পর্ব ( ১ম অংশ )
------------------------------------
প্রতিটি প্রাচীন জাতির পুরাণ আছে। এমন কোন পুরাতন জাতি নেই, যার পুরাণ নেই। তবে সব পুরাণ কালের প্রবাহে টিকে থাকে নাই। যেমন বিশাল গ্রিক বা রোমান পুরাণ এখন শুধুই বইপুস্তকেই সীমাবদ্ধ।
একইভাবে কেল্টিক, সুমেরীয়, আসেরীয়, আরব্য, পারস্য কোন পুরাণই এখন আর বই পুস্তক ছাড়া আর কোথাও চর্চিত হয় না। এদিক থেকে ব্যতিক্রম হল ভারতীয় পুরাণ। হিন্দু ধর্মের অবস্থানগত কারণে এখনো এ পুরাণ টিকে আছে। আবার বিভিন্ন সাহিত্যের উপাদান হিসেবেও এটি এসেছে ব্যাপকভাবে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের লেখায় পুরাণ যেভাবে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে, তা বোধ করি বাংলা ভাষাভাষি আর কোন কবি বা লেখকের লেখায় আসে নি। তবে আমাদের এখানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, একটি সাধারণ সংক্ষিপ্ত পরিচয় বা সূচীপত্র হিসেবেই আমরা এখানে তুলে ধরছি এ ভারতীয় পুরাণগুলো। স্মতর্ব্য যে, পুরাণের সংখ্যা-শ্লোক-ব্যাখ্যা ইত্যাদি কালের বিবর্তনের কারণে এবং মতান্তরে অবিসংবাদিত কোন বিষয় নয়।
হিন্দুদের প্রধান ধর্মশাস্ত্র বেদ। কিন্তু প্রধান হলে কি হবে, বিধির বিধানে এ বেদে শুধুই বর্ণশ্রেষ্ঠদের নিদান! অর্থাৎ, বেদ ছিল শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের জন্য। তাতে অন্য বর্ণ এবং নারীর প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ফলে বেদ যত না হল ভক্তিশাস্ত্র, তারচে’ বেশি হল ভয়ের অস্ত্র। অনেক পরে যাও বা এলো উপষিনদ, তার ভাব ভাষা এত খটোমটো আর দার্শনিক তত্ত্বগুলো এত উচ্চমার্গের যে, সাধারণ বা স্বল্পবিদ্যার মানুষের কাছে তা বেদের চেয়েও বেশি অধরা হয়ে গেল। এতে ভগবানের কিছু এসে যাক বা না যাক, অনেক কিছুই এসে গেল ব্রাহ্মণদের। কারণ, বাকি ত্রি বর্ণের মানুষ যদি ধর্ম বুঝতেই না পারল তবে ব্রাহ্মণদের কী মর্যাদা তা টের পাবে কী করে ? তখন ধর্মের অনুশাসন, ব্যাখ্যা, সামাজিক রীতিনীতিগুলো মানুষের কাছে সহজ করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আবির্ভূত হল এক মিশ্র সাহিত্য। এতে মিশিয়ে দেয়া হল ইতিহাস, ধর্মীয় বিধান, রূপক ব্যাখ্যা, কাহিনি, উপাখ্যান। সাহিত্যের সাথে সাথে যেন ধর্মের ব্যাখ্যাও হয়, তাই এতে আরো মিশিয়ে দেয়া ধর্মের চরিত্রগুলো। এটাই পুরাণ। ধর্ম না হয়েও যেন এক ছায়া-ধর্ম হয়ে গেল পুরাণ বা পৌরাণিক কাহিনিগুলো।
তাহলে প্রশ্ন হল - শুধুই কি ধর্মের ব্যাখ্যা সহজ করার জন্যই পুরাণের উদ্ভব ? এর জবাবটা একটু পেছন থেকে এগোতে হয়। বৈদিক যুগে ধর্মে দেবমুর্তির প্রয়োজন ছিল না। তখন ধর্ম ছিল যাগযজ্ঞ, হোম আর আহুতি নির্ভর। কিন্তু যজ্ঞের ঘি খাওয়া সে আগুনের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলা আর দুর্বোধ্য সংস্কৃত মন্ত্রে কানে তালা লাগানো ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে আর কোন অনুভূতি তৈরি হত না। ব্রাহ্মণেরা দেবতার দেখা বা ছোঁয়া কতটুকু পেত তা তারাই জানে ; কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখে যজ্ঞের কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে উপরে উঠে যতক্ষণ পুরোপুরি বাতাসে মিলিয়ে না যায়, ততক্ষণ এক ভগবানের চেহারা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা চলত। কথায় বলে চোখের আড়াল তো মনের আড়াল। তাই মনের আড়ালে ভগবান যাতে চলে না যায় সে জন্য এবং সাধারণ মানুষের মনের ভেতর দেবতাকে ঠাঁই দেয়ার জন্য এ পূজা রীতিকে সাকার মূর্তি আর ব্রতকেন্দ্রিক করে সহজ করে দেবদেবীদের মানবায়ন করা শুরু হয়, শুরু হয় অলৌকিক দেবগণের লৌকিক রূপায়ন। অগ্নি, বরুন, সূর্য প্রভৃতি বৈদিক দেবতার স্থানে আবির্ভূত হন চন্ডী, দূর্গা, গণেশ প্রভৃতি সাকার দেবতা। এদের ভেতরে দেয়া হয় মানবীয় দোষ-গুণ-হিংসা-প্রেম-কাম ; আর কোন কোন মানুষকে ঋষি-মুনির পরিচয়ে তাদের ভেতর আরোপ করা হল দেবত্ব। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে এ দেবদেবীরা খুব দ্রুত আপন হয়ে ওঠে। এতে সাধারণ মানুষ দেবতাদের সঙ্গে নিজেদের দূরত্ব ভুলে দেবতার আদর্শ নিজের জীবনে অনুসরণের প্রেরণা লাভ করে।
এত গেল ধর্মীয় দিক। এর পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণও ছিল। ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান, প্রসার এবং আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলে হিন্দুধর্ম বিপন্ন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আবার মৌর্য সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম প্রায় সরকারি ধর্মের মত হয়ে পড়লে হিন্দু ধর্ম মরণাপন্ন রোগীর পর্যায়ে চলে যায়। তখন কিছু হিন্দু সমাজপতিরা উদ্যোগ নেন হিন্দু ধর্মকে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে আবদ্ধ করতে, আবার একই সাথে এর বিধিনিষেধ, প্রথাগুলোকে সহজবোধ্য করতে। যেহেতু গল্পকাহিনি মানুষ সহজে পছন্দ, গ্রহণ এবং স্মরণ করতে পারে, তাই গল্পকথার প্রাধান্য দিয়ে তারা রচনা করেন বিশাল পৌরাণিক সাহিত্য। সৃষ্টি হয় পুরাণ।
এ পুরাণ যে উদ্দেশ্যেই ব্যবহার হোক না কেন, এটা পরবর্তীতে মিশে গেছে আমাদের জীবনবোধের সাথে, জীবনপ্রণালীতে, জীবনধারাতে। আমাদের প্রতিদিনের ছোটখাট বিভিন্ন খুঁটিনাটি ঘটনার ব্যাখ্যাও পুরাণে পাওয়া যেতে লাগল গল্পের মাধ্যমে। ফলে তা একসময় ধর্মপুস্তকের চাইতেও বেশি আদরণীয় হয়ে ওঠে, এবং আজও। পুরাণের বিভিন্ন কাহিনি-আখ্যান-উপাখ্যানগুলো হয়ে গেল আমাদের কথা-লেখা-সাহিত্যের অঙ্গ ; তা সে সরাসরি হোক, বা পরিবর্তিতরূপে। যেমন আমরা শৈশব হতেই শুনে আসছি চাঁদ মামা, সুয্যি মামার কথা। প্রশ্ন হল কোন রিস্তেদারীতে এরা আমাদের মামা হয় ? উত্তর আছে পুরাণে। লক্ষ্মীদেবী হলেন মাতা। আর ক্ষীরোদসাগরসম্ভূত চন্দ্র তাঁর সহোদর ভ্রাতা। সেই সূত্রে চাঁদ আমাদের মামা। এবার আসি সুয্যি মামার ঠিকুজি খুঁজতে। বিষ্ণু পুরাণমতে - প্রলয়কালে যখন এক ব্রহ্ম ছাড়া আর কেউ ছিল না, সে সময়ে ব্রহ্মার ক্ষোভ থেকে আদিত্য ও দেবগণ আবির্ভূত হলেন। আদিত্য হল সূর্য। যে মহার্নবের একটি ক্ষুদ্র অংশ ক্ষীরোদসাগর থেকে চন্দ্রের জন্ম, সে মহার্নব থেকেই সূর্যেরও জন্ম হল। ফলে সূর্য-চন্দ্র দুই ভাই। তাই, চাঁদ যেহেতু মামা, সুয্যিও মামা।
কিংবা, আমাদের অতি বাল্যকালের একটা ছড়ার কথাই বলি-
“আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে / ঢাক ঢোল ঝাঁঝর বাজে।
বাজতে বাজতে চলল ঢুলী / ঢুলী গেল কমলাফুলি।
কমলাফুলির টিয়েটা / সূয্যিমামার বিয়েটা।“
মুখে মুখে বিকৃত হয়ে যাওয়া ছড়াটির এবার আসি মূল ছড়ায় -
“আগডোম বাগডোম, ঘোড়াডোম সাজে / লাল মেঘে ঘুঙুর বাজে।
বাজাতে বা্জাতে চলল ঢুলী, / ঢুলী গেল কমলাপুলি।
কমলাপুলির টিয়েটা / সুজ্জিমামার বিয়েটা।“
বর্ষা শেষ হয়েছে। এমনি একদিন সন্ধ্যা কালে এক তেজস্বী ঘোড়ায় চড়ে সূর্য ঠাকুর বিয়ে করতে চলেছেন। বেগবান অশ্বের গতিতে তার গায়ে পরানো স্বর্ণের সূক্ষ্ম জাল হতে এক ঝঙ্কার ধ্বনি আসছে। অশ্বের খুরের আঘাতে চারদিকের মেঘের ধুলায় লালে লাল। লাল আভায় পশ্চিমাকাশ রাঙ্গা। আর রথের চাকার আওয়াজ অর্থাৎ ঘাঘর যেন ঘুঙুরের মত ছন্দময়। অশ্বের সামনে সামনে ডোমেরা যাচ্ছে (সে কালে ডোমেরা সহিস ও সৈন্য হত)। আগ ডোম বা আগে থাকা ডোমেরা সামনের ভক্তজনতাকে সরাচ্ছে, বাগ ডোম অর্থাৎ বাদক ডোমেরা নানান বিয়ের বাদ্য নিয়ে আগাচ্ছে। তার পিছনে ঘোড়া ডোম অর্থাৎ অশ্বারোহী সেনারা সূর্যদেবের আগে আগে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য কমলাপুলি ( কমলাপুরী, কমলালয়, আকাশ-সমুদ্র ) পৌঁছানো , সেখানে অপেক্ষায় আছে ‘টিয়েটা’ অর্থাৎ বিয়ের ‘ঝিয়েটা’ ( মেয়েটা বা পাত্রীটার অপভ্রংশ রূপ)। মার্কন্ডেয় পুরাণে আছে 'ছায়া' নামে (ঋগ্বেদে নাম আছে – সবর্ণা) এক কন্যার সাথে কমলাপুরীতে এক সন্ধ্যাকালে সূর্য দেবের সাথে বিবাহ হয়েছিল।
এভাবেই পুরাণ আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আর জীবনের সাথে মিশে আছে, অলক্ষ্যে।

ভূমিকা পর্ব ( শেষ অংশ )
-------------------------------------

............... তো সুয্যি মামার বিয়ের কথা যখন উঠলই, চাঁদ মামার বিয়েটাই বা বাকি থাকে কেন ? বিশেষ করে সে বিয়ের সাথে যেখানে জড়িয়ে আছে চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা আর কবিতার উপমা ! সে অতি প্রাচীন কালের কথা। ব্রহ্মার মানসপুত্র প্রজাপতি দক্ষ তাঁর বিবাহ যোগ্যা সুন্দরী ২৭ জন নক্ষত্র কন্যার জন্য পাত্র খুঁজছেন। চন্দ্র ছাড়া রূপবান আর তেমন কাউকে পেলেন না। তাই ২৭ কন্যাকেই চন্দ্রের হাতে তুলে দিলেন। শ্বশুর মশাই শুধু এটুকু আশা করলেন যে, স্বামী হিসেবে চন্দ্র ২৭ স্ত্রীকেই সমান ভালবাসবে। কিন্তু স্ত্রীদের মধ্যে রোহিনীর রূপে আর কামকলায় চন্দ্র এত মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে, তার ঘরে একবার ঢুকলে আর অন্য স্ত্রীদের কথা মনেই আসে না ; এমনকি রোহিনীর ঘর থেকে বেরও হন না। তখন ভালবাসা বঞ্চিত বাকি ২৬ বোন তাদের পিতাকে দুঃখের কথা জানালে শ্বশুর দক্ষ জামাতাকে সাবধান করে দিলেন। কিন্তু ফলাফল ঐ একই। তখন ক্ষেপে গিয়ে শ্বশুর অভিশাপ দিয়ে বসলেন চন্দ্রকে,” দেবতা হয়েও তুই ন্যায়নীতিহীন ! যা তুই সন্তানহীন হ, তোর ক্ষয়রোগ হোক, তোর যক্ষ্মা হোক।“ যার তার নয়, চন্দ্রের যক্ষ্মা বলে কথা ! তখন থেকেই যক্ষ্মা রোগকে বলা হয় রাজরোগ। আর ২৭ জন স্ত্রী নিয়েও নিঃসন্তান বলেই চাঁদের কোন উপগ্রহ (সন্তান) নাই এবং এ কারণেই তার নিজস্ব গৌরবের আলো নাই ; ভ্রাতা সূর্যের আলোতে সে আলোকিত। এই হল চাঁদের উপগ্রহ আর নিজস্ব আলো না থাকার কারণ।

ওদিকে অভিশাপের কারণে চন্দ্রের যক্ষ্মা দেখা দিল, ক্ষয় শুরু হল। ২৭ কন্যাই এবার স্বামীর এ অবস্থা দেখে রাগ ভুলে পিতার পায়ে গিয়ে পড়ল,” বাবা, ফিরিয়ে নাও তোমার শাপ”। তখন পিতা দক্ষ বললেন,” একবার শাপ দিলে তা ফেরানো যায় না। ঠিক আছে, এখন থেকে চন্দ্রের ১৫ দিন ক্ষয় হবে, আর পরের ১৫ দিনে সে ক্ষয় পূরণ হবে।“ ব্যস ! এভাবেই তৈরি হল কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ। আর চন্দ্রের গায়ে যক্ষ্মার ক্ষয়ের দাগ ‘চাঁদের কলংক’ হিসেবে কবিদের মুখে চিরস্থায়ী হয়ে গেল।

বেদ বা উপনিষদের অলৌকিক দেবকূলকে সাধারণের স্পর্শে নিয়ে আসতে গিয়ে পুরাণকাররা আর কিছু করুন আর না করুন, দেবতাদের কখনো কখনো করুণ হাল করে ছেড়েছেন ! জরা-ব্যাধি-মৃত্যুকে ঠেকাবার বর দেয়ার অধিকারী ছিলেন যে দেবতারা, তারাই ভুগতে শুরু করলেন বিভিন্ন রোগেশোকে ! বলা বাহুল্য, তাদের দ্বারা বেশকিছু রোগের সূচনাও হয়। যেমন- ক্ষুধামান্দ্য বা অরুচি রোগ। যে দেবতার যজ্ঞই হোক না কেন, ঘি খেতে হয় অগ্নিকেই। ক্রমাগত ঘি খেতে খেতে বেচারার ক্ষুধা মরে গেল। দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারভাইয়েরা পরীক্ষা শেষে মত দিলেন অগ্নিদেবের ক্ষুধামান্দ্য রোগ হয়েছে ; রোগের উপশমের জন্য প্রচুর ভাজাপোড়া মাংস খাওয়া প্রয়োজন। রুচি ফেরানোর জন্যই খাণ্ডব বন পুড়িয়ে সব প্রাণির পোড়া মাংস খাওয়ানো হয় অগ্নিকে। তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।

আবার সৃষ্টির প্রথম যৌনরোগের স্রষ্টাও দেবতারাই। প্রজা সৃষ্টির পর সেই প্রজাদের বিশিষ্ট ও নিখুঁত প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্রহ্মা এক কন্যা সৃষ্টি করেন। অদ্বিতীয়া সুন্দরী ও সত্যপরায়ণা বলে ব্রহ্মা তাঁর নাম রাখেন অহল্যা। ব্রহ্মা অহল্যার সাথে ঋষি গৌতমের বিয়ে দেন। এই গৌতমের কাছে শাস্ত্র শিখতে আসেন দেবরাজ ইন্দ্র, লাম্পট্য-বিদ্যায় যিনি কিনা বহু আগের পণ্ডিত। একদিন সুযোগ বুঝে গৌতমের অনুপস্থিতিতে গুরুপত্নীকে ধর্ষণ করে এক বিরল গুরুদক্ষিণা দান করে বসলেন ইন্দ্র। বাড়ি ফিরে জানতে পেরে গৌতম ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন এবং এর ফলে ইন্দ্রের সারা দেহে শতশত যোনির সৃষ্টি হয়। ইন্দ্র পড়লেন বেকায়দায়, না কারো সামনে আসতে পারেন, না শতযোনির চিহ্ন ঢাকতে পারেন। আধুনিককালের কোন যৌনরোগের সাথে এর সাদৃশ্য না থাকলেও, এমনকি শতযোনি ব্যাপারটা রূপক হলেও, নিঃসন্দেহে পুরাণমতে ইন্দ্রদেবই যৌনরোগের ধারক, বাহক ও প্রথম রোগি।

মজার ব্যাপার হল, পুরাণে অতি ছোটখাট বা তুচ্ছ খুঁটিনাটি বিষয়ও উঠে এসেছে যা পাঠক মনের জন্য আনন্দের খোরাক। যে রাগরাগিণীযুক্ত উচ্চাঙ্গসঙ্গীতকলা হিন্দুপুরাণে এবং ধর্মে রীতিমত সাধনা করে সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে লাভ করতে হয়, সে বিদ্যার প্রথম বেসুরো গায়কিও পুরাণে দেখানো আছে। পুরাণ মতে ব্রহ্মার মানসপুত্র নারদ সর্বদাই নানা রাগ-রাগিণী যুক্ত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তিনি হাতে একটা বীণা নিয়ে সবসময় বাজাতে বাজাতে গান করতেন। কিন্তু সবসময় তাঁর সঙ্গীতে কিছু না কিছু ত্রুটি-বেসুর থেকেই যেত। ব্রহ্মার মানসপুত্র বলে কেউ কিছু বলারও সাহস পায় না। এদিকে নারদ এই ত্রুটি নিজে ধরতে পারতেন না, বরং নিজের গান নিয়ে খুব গর্ব করতেন, ভাবতেন তাঁর গান শুনে সবাই ধন্য ধন্য করছে। কিন্তু কাঁহাতক আর সহ্য করা যায় ! ক্রমাগত বেতাল-বাদন আর বেসুরো-গায়নে অতিষ্ঠ রাগ-রাগিণীরা শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল নারদের এই গর্বকে খর্ব করার জন্য তারা স্বশরীরে আবির্ভূত হবে। তবে সে শরীর হবে ঠিক সেরকম - যেরকমভাবে নারদ বাজাচ্ছেন বা গাইছেন। হঠাৎ একদিন নারদ দেখতে পেলেন তাঁর যাত্রা পথে সব বিকলাঙ্গ, বিকৃত, বিদঘুটে নর-নারীরা একেবারে মিছিল করে উপস্থিত ! তিনি যেদিকে যান, তারাও সেদিকেই যায়। বিস্মিত নারদ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন তারা সবাই নারদের বিকৃত সঙ্গীতের প্রকৃত রূপ! লজ্জা পেয়ে নারদ এরপর সঠিকভাবে সঙ্গীতকলা শিক্ষার সাধনা শুরু করেন। (বর্তমানকালের “যাচ্ছেতাই সঙ্গীত একাডেমি”র ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম শিল্পী’দের এ পুরাণটি অবশ্যই পড়া উচিৎ।)

আবার প্রেমের ব্যাপারে যদি আসি, মিলন বা বিরহ – উভয় শাখাতেই প্রচন্ড রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন অজস্র পৌরাণিক কাহিনি আছে প্রায় প্রতিটা পুরাণেই। দেবদেবী, যক্ষ, অসুর, মানব, গন্ধর্ব, ঋষি, দেবলোকের বেশ্যা-নর্তকী সবার সব ধরণের সম-অসম প্রেমের কাহিনি আছে এখানে। আর এগুলোর সাথে মিশে আছে অসংখ্য পার্থিব বস্তুর ব্যাখ্যা। যেমন ধরি, আমাদের অনেকেরই প্রিয় শিউলি ফুলের কথা। শিউলির গন্ধে আমরা বিমোহিত। কিন্তু কেন এর ফল হয় না ? কেনই বা এ ফুল সূর্যের স্পর্শমাত্র ঝরে পড়ে ? যেখানে পুজার সকল ফুল গাছ বা বোঁটা থেকে সংগ্রহ করা হয়, সেখানে শিউলি কেন মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েও ব্যবহার করা যায় ? এসব কেন’র উত্তর আছে পুরাণে। শিউলির আরেক নাম পারিজাত। স্বর্গের ফুল এটি। এ ফুল মর্ত্যে পাওয়া যায় না। কিন্তু কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামা আর রুক্সিণী - দুজনেরই ইচ্ছে তাদের বাগানে এ ফুল থাকুক। এমনিতেই কৃষ্ণ কখনো কোন নারীকে বিমুখ করেছে বলে জানা যায় না, আর এ দু’জনতো রীতিমত তার স্ত্রী। কিন্তু সমস্যা হল যে, স্বর্গের সংবিধানও তো ভগবান কৃষ্ণেরই রচনা যাতে পারিজাত শুধু স্বর্গের শোভা, আবার নিজের স্বার্থে তো আর সেটার যখন তখন সে স্বর্গীয় সংবিধানে সংশোধনীও আনা যায় না। তাই কৃষ্ণ, যার মানবীয় কাম-প্রেম সব কাজই লীলা বলে আখ্যায়িত, স্ত্রীর মন রক্ষার্থে স্বর্গের বাগান থেকে পারিজাতের একটি ডাল চুরিই করে বসলেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর বাগানে রোপিত সে ডালের ফুল থেকে যখন ঘ্রাণ ছড়ালো, তখন দেবরাজ ইন্দ্র রাগে ফেটে পড়লেন। কিন্তু রাগলে কী হবে ? বিষ্ণু-অবতার কৃষ্ণকে শাস্তি দেয়া ইন্দ্রের সাংবিধানিক ক্ষমতার বাইরে। তাই তিনি অভিশাপ দিলেন বেচারি পারিজাত ফুলকে। আর তার সে অভিশাপের কারণেই মর্ত্যের পারিজাত ফুল কখনোই ফল দিবে না, অর্থাৎ তার বীজে কখনোই নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না।

আবার আরেক পুরাণের গল্পে আছে – পারিজাতিকা নামে এক রাজকন্যা সূর্যদেবের প্রেমে পড়ে। তাকে পাবার ব্যর্থতায় সে আত্মহত্যা করে। তার দেহের ছাই পবিত্র ভালবাসার কারণে পারিজাতবৃক্ষ রূপে ফুটে ওঠে। আর সূর্যদেবের বরে সে বৃক্ষের ফুল হয়ে ওঠে অশ্রুবিন্দুর মত যেটা ঝরে পড়বে সূর্যের আলোর স্পর্শে। এবং একারণেই শিউলি ফুল পবিত্রতার প্রতীক যা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেও পূজা হয়।

শুধু এটুকুই নয় ; সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ সহ সবকয়টা গ্রহ-নক্ষত্রমন্ডলীর উৎপত্তি, অবস্থান ও এর কারণ নিয়ে কাহিনি আছে। এভাবে প্রেম-কাম, যুদ্ধ-সন্ধি, জয়-পরাজয় সবকিছু নিয়ে জড়িয়ে আছে পুরাণের শাখাপ্রশাখা। আর প্রতিটা কাহিনিতেই লৌকিক বা অলৌকিক দেবদেবিরা মানবায়িত হয়ে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, কোথায় যে ধর্মের শেষ আর পুরাণের শুরু, কিংবা উল্টোটা - বলা মুশকিল। এমনকি আমাদের মুখের ভাষাতেও আমাদের অজান্তেই প্রবাদপ্রবচন, বাগধারা হিসেবে মিশে গেছে অসংখ্য পুরাণের শব্দ-বাক্য। যেমনঃ বাতির নিচে অন্ধকার(ওঝার ব্যাটা বনগরু), মান্ধাতার আমল, জড়ভরত, অগস্ত্য যাত্রা, ধুন্দুমার কাণ্ড, রক্তবীজের ঝাড়, কালনেমির লঙ্কাভাগ (গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল), কুম্ভকর্ণের নিদ্রা, রাবণের গুষ্টি, রামরাবণের যুদ্ধ, ঘরের শত্রু বিভীষণ, লক্ষ্ণণ ভাই, রাবণের চিতা, লঙ্কাকাণ্ড, কুবেরের ধন, অগ্নিপরীক্ষা, পাণ্ডববর্জিত দেশ, বিদুরের খুদ, গজকচ্ছপের লড়াই, বালখিল্যতা, ধ্রুব সত্য, সাক্ষি গোপাল, ......... আরো কত ! প্রতিটা প্রবাদের পেছনেই আছে মজার সব গল্প-কাহিনি।

শোনাই যাক না কয়েকটা ! আসুন শুরু করি ........................

Post a Comment

0 Comments

Close Menu