কিছুক্ষণ
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
রিভিউ লেখকঃ নাফিসা আইরিন
মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা ভাল না।প্লেসেন্টা এখনো বের হয়নি।অস্বাভাবিক রক্তপাত হচ্ছে।এই মহিলাকে অতি দ্রুত হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন।জঙ্গলে ট্রেন থেমে থাকলে গুরুতর
সমস্যা হবে।মাওলানা সমস্যার ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না।পুত্র লাভ উপলক্ষে তিনি শোকরানা নামাজ শেষ করেছেন।আনন্দিত মুখে বারবার তাঁর কামরায় উঁকি দিচ্ছেন।বাচ্চা কোলে নিয়ে সাজেদা বেগম বসে আছেন।সমস্যার জটিলতা তিনি বুঝতে পারছেন।একটু পর পর চিত্রাকে বলছেন,বৌমা খোঁজ নাও ট্রেন কখন ছাড়বে।কামড়ায় আশহাব আছে।সে ক্ষনে ক্ষনে মার কাছ থেকে ধমক খাচ্ছে-তুই তো গাধা ডাক্তার।কিছু করতে পারছিস না এটা কেমন কথা।তুই কি নকল করে পাস করেছিস যে কিছু জানিস না।গাধার গাধা।তোর বাপ ছিল গাধা।তুইও গাধা!
এমন কঠিন সময়ে মাওলানা উঁকি দিল এবং সবগুলি দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করল,খালাম্মা ছেলে কি আমার মতো হয়েছে?
সাজেদা বললেন,ছেলের গালে ছাগলা দাড়ি নাই।ছেলে তোমার মতো হয় নাই।ছেলে কার মতো হয়েছে এই চিন্তা বাদ দাও।তোমার বৌকে বাঁচাবার চেষ্টা কর।
মাওলানা বললেন,কঠিন দোয়ার মধ্যে আছি খালাম্মা।দেখবেন
কিছুক্ষনের মধ্যে ইঞ্জিন ঠিক হবে ইনশাল্লাহ্।আমরা
একটানে ময়মনসিংহ পৌঁছে যাব।
সাজেদা বললেন,আল্লাহ্পা
ক কি ইঞ্জিন ঠিক করার জন্য ফেরেশতা পাঠায়েছেন?
মাওলানা বললেন,এই ধরনের কথা বলবেন না খালাম্মা।বিরাট পাপ হবে।এইসব খোদা নারাজি কথা।
খোদা তোমার মতো না।এত্ত সহজে তিনি নারাজ হন না।তুমি আমার সামনে থেকে যাও।তুমি হচ্ছ রামছাগল।ট্রেন থেকে নেমে দেখ কাঁঠাল গাছ পাও কি-না।যদি পাও পাতা ছিঁড়ে পাতা খাও।
ড্রাইভার সাহেব বলেছেন,ইঞ্জিনের মূল পিস্টন ভেঙে গেছে।উদ্ধারকারী ইঞ্জিন না এলে কিছু করা যাবেনা।চার পাঁচ ঘন্টা লাগবে।রশীদ সাহেব জানালার পাশে দাড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন।তার সামনে আশহাব চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।
রশীদ উদ্দিন বললেন,মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা কি?সে কি চার পাঁচ ঘন্টা সারভাইভ করবে?
আশহাব বলল না,আমাদের হাতে বড় জোর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে।
***
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চিত্রা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে।চোখের সামনে একটা মেয়ে মরে যাচ্ছে এই দৃশ্যটা সে নিতে পারছে না।মাওলানার স্ত্রী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার ছেলের দিকে।ছেলেও ড্যাব ড্যাব করে মা'কে দেখছে।কি অদ্ভুত এবং কি করুন এক দৃশ্য!এই দৃশ্য বেশীক্ষন সহ্য করা মুশকিল।চিত্রা বের হয়ে চলে এসেছে।
বাথরুমের পাশের ঘরের দরজা খুলল।একজন ভদ্রমহিলা এসে চিত্রার পাশে দাঁড়ালেন।চিত্রাকে চমকে দিয়ে তার পিঠে হাত রাখলেন।নরম গলায় বললেন,মা'গো!আমি খবর পেয়েছি মেয়েটা মারা যাচ্ছে।কেঁদে কি আর মৃত্যু ফেরানো যায়।
চিত্রা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,মৃত্যু ফেরাবার জন্য কাঁদছিনা।কষ্টে কাঁদছি।এক ঘন্টা সময় হাতে পেলেও মৃত্যু ফেরানো যেত।
মহিলা বললেন,মা আমি ব্যবস্থা করছি।একটা হেলিকপ্টার আনার ব্যবস্থা করছি।এই জায়গার ঠিক লোকেশন দরকার।রেলের কাউকে খবর দিয়ে আনতে পারবে?যার মাধ্যমে ঠিক ঠিক লোকেশনটা আমি জানতে পারি?
হতভম্ব চিত্রা বলল,আপনি কিভাবে হেলিকপ্টার আনবেন?আপনার পরিচয় জানতে পারি?
মহিলা বললেন,আমার একটাই পরিচয়।আমি একজন দুঃখী মা।ছেলের ডেডবডি নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি।আমার একটাই ছেলে।ছেলের বাবা মারা গেছেন দশ বছর আগে।সময় নষ্ট করে লাভ নেই তুমি রেলের কোনো একজনকে ডাক।
ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার রওনা হয়েছে।দু'জন মাত্র যেতে পারবে।রোগীর সঙ্গে যাচ্ছে তার ছেলে এবং আশহাবের মা সাজেদা বেগম।তিনি চিত্রাকে ডেকে কঠিন ভঙ্গিতে বলেছেন-বৌমা আমার ছেলেকে তোমার হাতে রেখে গেলাম।চোখে চোখে রাখবে।সুযোগ পেলেই যেন চুকচুক করে কিছু না খায়।এতদিন আমি দেখেছি।এখন তুমি বাড়ির বৌ তুমি দেখবে।
রশিদ উদ্দিন পাশেই ছিলেন।তিনি চমকে উঠে বললেন,তোমরা এই ফাঁকে বিয়েও করে ফেলেছ।আশ্চর্য তো!
সাজেদা বিরক্ত হয়ে বললেন,আশ্চর্য হবার কি আছে?বয়স হয়েছে বিয়ে করবে না?ধেং ধেং করে প্রেম করে বেড়াবে?কৃষ্ণ লীলা আমার পছন্দ না।আমি প্রেম করার বিপক্ষে।প্রেম যদি করতেই হয়-বিয়ের পরে করা উচিত।সবচে ভাল হয় না করলে।
রশিদ উদ্দিন বললেন,আপনার কথাবার্তা আমার অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে।আপনার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হওয়া অতীব জরুরি।
সাজেদা আঁচল তুলে ঘোমটা দিতে দিতে চিত্রাকে বললেন,বৌমা!বুড়োটাকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো।বেলাজ বুড়া।
-কিছুক্ষণ।
সম্পূর্ন উপন্যাসটি কিছু মানুষের একটি ট্রেন যাত্রার উপর ভিত্তি করে তৈরি।সাধারন একটি ট্রেন যাত্রাকে লেখক তার বর্ণনার মাধ্যমে অসাধারন করে তুলেছেন।
ব্যাক্তিগত রেটিং-৭.৮/১০
নিঃসন্দেহে এই বই পড়ে আমার মতো কোনদিন ট্রেনে ভ্রমনের সুযোগ না পাওয়া মানুষগুলোর ইচ্ছে হবে ট্রেনে চেপে কোথাও যেতে।
0 Comments