Ad Code

Responsive Advertisement

পাঠ অভিজ্ঞতাঃ শাহাদুজ্জামানের গল্প

লিখেছেন: মাহাদী হাসান

পাঠ অভিজ্ঞতাঃ শাহাদুজ্জামানের গল্প
“খোয়াবনামা” পড়ে মুগ্ধ হয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কাছে স্তুতি স্বরূপ চিঠি পাঠিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী । সেই চিঠি পেয়ে আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি তখন লিখেছিলেন, “ওটা পড়ে আমি দারুণ উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি,
উচ্ছ্বাসের সাথে থাকে প্রবল উত্তেজনা। অতো উত্তেজনা নিয়ে কিছু লেখা মুশকিল”। উত্তেজনা কমে এলে আবেগ যখন থিতু হয় তখন লিখতে হয়। আমার অবস্থা এখন যদি বর্ণনা করি তাহলে এইরূপই হবে। আমি এখন প্রবল উত্তেজিত, খুব বেশি আবেগে আক্রান্ত। তবে আমি আমার আবেগের কথা এই বেলাতেই বলতে চাই, কেননা আমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতন বড় কোন লেখক নই যে আমাকে নিরপেক্ষ দিক থেকে সকল কিছু বিবেচনা করে লিখতে হবে। আমার লেখা আবেগ সর্বস্ব হলেও আমি খুশি, কেননা আমি পাঠক; আমি কোন সমালোচক নই তাই আমার লেখা বায়াসড হবেই, আমি আবেগে অভিভূত হয়ে আমার আবেগের কথা বলতেই না আঙ্গুল চালিয়েছি কী বোর্ডে।
আমার প্রথম শাহাদুজ্জামান পাঠ যে এতটা সুতীব্রভাবে আন্দোলিত করবে আমার ভেতর বাহির, এতটা নাড়া দিবে আমার সমগ্র অস্তিত্বে সে কথা কল্পনাতেও আনিনি আমি যখন তাঁর বই প্রথম হাতে নিয়েছিলাম। পরপর তিন দিনে মোট ৩৫টি গল্প শেষ করার পর যখন স্থির হয়ে রাতের অন্ধকারে নক্ষত্রের আলোয় বসে ভাবি, কি পড়লাম, তখন মাথার ভেতরে কেবল সংলাপের পর সংলাপ পাক খায় আর আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমার পড়ার জগতটা কত ছোট ছিল! আমার চিন্তার জগত কতটা ক্ষুদ্র!
প্রথা ভাঙ্গা লেখা বা লেখক দুটোর কোনটাই খুব বেশি চোখে পড়ে না আজকাল। প্রথা বলতে আমি এখানে গল্প বলার ধরণকে বোঝাচ্ছি, গল্পের কাঠামোকে বোঝাচ্ছি, গল্পের চরিত্রায়ন এবং চরিত্র বিশ্লেষণকে বোঝাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ-প্রভাতকুমার যে স্টাইলে গল্প বলে গেছেন সেই একই স্টাইলে গল্প বলে গেছেন তাঁদের উত্তরসূরিরা এবং এখনও বলে যাচ্ছেন আমাদের বর্তমান কালের লেখকেরা অর্থাৎ সুনীল-সমরেশ থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত। অর্থাৎ অপরিবর্তনশীল গল্প বলার ধারা, যেখানে পাত্র থাকবে, পাত্রী থাকবে, তাঁদের মাঝে সংলাপের পর সংলাপ চলবে, একটা ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং শেষ পর্যায়ে এসে থাকবে একটা ক্লাইম্যাক্স, একটা চমক, যাতে পাঠক মুখ থুবড়ে পড়ে ভাববে, এমনটা তো ভাবিনি কখনও, ব্যস, এই তো হয়ে গেল একটা গল্প। এই যে গল্প বলার একটা ধারা বা ট্রাডিশান তা কখনও কখনও পরিবর্তিত হয়ে আলাদা একটা রূপে দাড়ায় কোন কোন লেখকের দ্বারা। সেই লেখকদের একজন হলেন শাহাদুজ্জামান।
শাহাদুজ্জামান খুব সাধারণভাবে গল্প বলেন। কখনও মন্থর গতিতে কখনোবা দ্রুতলয়ে কিন্তু কখনই তা পাঠকের কাছে অবোধগম্য করে নয়। তাঁর গল্প পড়লে যেন মনে হয় সে আমাদের আশেপাশে থেকেই গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন অবিরত। আমরা তাঁর গল্পের দিকে চোখ রাখলে দেখতে পাই যে তিনি প্রতিটা গল্পের আলাদা আলাদা ফর্ম তৈরি করেছেন। তাঁর “মিথ্যা তুমি দোষ পিঁপড়া” গল্পের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, সেখানে তিনি মাত্র ৩টা চিঠির মাধ্যনে একজন সেনাবাহিনী কর্মকর্তার মানসিকতা কি নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। অপরদিকে “ক্ষত যত ক্ষতি যত” গল্পে তিনি যেন প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে গল্প বলে গেছেন এই পঙ্কিল সমাজের, “অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প”টিতে লেখক দুই বন্ধুর মধ্যে জীবনানন্দ দাশের গল্প নিয়ে আলোচনা চালিয়ে লিখে গেছেন একটা গল্প, আবার “অপুষ্পক” গল্পে লেখক একজন থিসিসরত ছাত্রীর লেখা মেমোকে উপজীব্য করে লিখেছেন একটি গল্প। এইরকম প্রতিটা গল্পে লেখক যা করেছেন তা হল চলমান গল্পের স্ট্রাকচারকে ভাঙ্গা, লেখক প্রচলিত ধারায় গল্প বলেননি। একটি গল্পের স্ট্রাকচারের সাথে আরেকটি গল্পের স্ট্রাকচারের মিল যেন লেখক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই রাখেন নি। আবার কাহিনী নির্বাচনেও বিচিত্রতার পরিচয় দিয়েছেন লেখক। কখনও তাঁর গল্পে উঠে এসেছে আমাদের চারপাশের নষ্ট সমাজের কথা কখনও উঠে এসেছে মানব মনের অন্ধকার দিক তাঁর অলিগলির কথা, কখনও এসেছে আনন্দ বেদনার নিখুঁত কাব্য আবার কখনবা এসেছে শুধুই হিউমার।
শাহাদুজ্জামান বাম ঘরনার লেখক হিসেবে লেখক-পাঠক উভয় মহলে বেশ পরিচিত। তাঁর গল্পের ক্যারেক্টার গুলোর দিকে তাকালে আমরা যেন সেই কথারই প্রতিফলন দেখতে পাই। তাঁর গল্পের প্রতিটা ক্যারেক্টারই যেন রাজনীতি সচেতন, সমাজতান্ত্রিক আদর্শে আদর্শিত। এতো কিছুর পরেও লেখকের সুস্পষ্ট মত আর শক্তিশালী লেখনিকে অগ্রাহ্য করার মতন কোন শক্তি কোন সৃজনশীল পাঠকের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে আমার বিশ্বাস। যদিও লেখকের শেষ গল্পগ্রন্থে আমি বেশ পার্থক্য টের পেয়েছি তাঁর পূর্ববর্তী লেখার সাথে। লেখক যেন এখানে একটু বেশীই স্তিমিত হয়ে পড়েছেন, আগের লেখাগুলোর মত তেমন জোর খুঁজে পাচ্ছিলাম না তবুও তা ছিল উপভোগ্য শাহাদুজ্জামানের অপরাপর লেখার মতই। লেখকের দুইটি শব্দের প্রতি অন্যরকম একটা টান ভীষণ ভাবে চোখে পড়ার মতন- “বিহ্বল” আর “নিরালম্ব”। পড়তে গিয়ে মনে হয় শব্দ দুটির মালিকানা তিনি পৈতৃক সূত্রে ও ফৌজদারি মামলায় উভয় ভাবে পেয়ে গেছেন তাই তো এমন যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন তাঁর প্রতিটা গল্পে।
শাহাদুজ্জামান-এর মোট গল্পগ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটি। সেগুলো হল-
১।কয়েকটি বিহ্বল গল্প (মাওলা ব্রাদার্স, গায়ের মূল্য- ১০০ টাকা),
২।পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ (মাওলা ব্রাদার্স, গায়ের মূল্য- ১৫০ টাকা),
৩।কেশের আড়ে পাহাড়(ঐতিহ্য, গায়ের মূল্য- ১৭০ টাকা),
৪।শাহাদুজ্জামানের গল্প, অগল্প, না-গল্প সংগ্রহ (পাঠক সমাবেশ, গায়ের মূল্য- ৫৯৫ টাকা)
৫।অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প (মাওলা ব্রাদার্স, গায়ের মূল্য- ২০০ টাকা)
সবার শাহাদুজ্জামান পাঠ হোক এক নতুন দিগন্তের সূচনা এই কামনায় সবাইকে ধন্যবাদ।

Post a Comment

0 Comments

Close Menu