লিখেছেন: সাকু চৌধুরী
বই রিভিউঃ দি আইভরি চাইল্ড
মূলঃ হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড
রূপান্তরঃ সাইফুল আরেফিন অপু
====================
হ্যাগার্ডের বই বা লেখার সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়া মানেই বাহুল্য। তাঁর লেখা কখনো কেউ চোখ দিয়ে পড়েছে বলে মনে হয় না। তাঁর লেখা পড়তে হয় ভেতরের চোখ দিয়ে, তৃতীয় নয়নে। এ জন্যই তাঁর বই পড়তে গিয়ে পাঠকের কখনো গলা শুকিয়ে যায়, কারণ পাঠক তখন দাঁড়িয়ে আছে আফ্রিকার বিশাল মরুতে ; কখনো বা পাঠকের কলজে ঠান্ডা হয়ে যায়, কারণ পাঠক নিজেকে হঠাৎ আবিষ্কার করেছে দুই নরখাদক জংলিদলের লড়াইয়ের মাঝে যেখানে যে দলই জিতুক, খাদ্য সেই ; আবার কখনো পাঠকের চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে এক রহস্যময় অবগুণ্ঠন যার ব্যাখ্যা সুদূর কোন অতীতে ছিল বা কখনোই থাকার নয় ! মোদ্দা কথা, হ্যাগার্ডের লেখায় পাঠকের সম্মোহন অবশ্যম্ভাবী।
আর এবারের সে সম্মোহন ক্ষেত্র ইংল্যান্ডের এসেক্স হয়ে আফ্রিকার অনেক ভেতরে উত্তরের এক মরুভূমির পাড়ে। এসেক্সের অত্যন্ত অভিজাত এবং ইংল্যান্ডের অত্যন্ত ধনবান তরুণ লর্ড রেগ্ন্যালের সাথে অ্যালান কোয়াটারমেইনের পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটে পাখি শিকারের মধ্য দিয়ে। তারপর তাঁর ক্যাসলে গিয়ে পরিচয় ঘটে লর্ডের বাগদত্তা লুনা হোমসের সাথে। পরিচয়ের প্রারম্ভেই অ্যালানের চোখে পরে লুনার গলার নিচে এক জন্মদাগ - বাঁকা চাঁদ। লুনাও খুব আগ্রহী আফ্রিকা সম্বন্ধে, আর কেমন এক ঘোরলাগা ভাবে বলে তার মনে হয় কোন এক দিন আফ্রিকার কোথাও অ্যালানের সাথে তার দেখা হবে।
বিভিন্ন নিরুপদ্রব ঘটনাচক্রের ভেতর দিয়ে এরপর কাহিনি এগোয়। তারপর আবির্ভাব ঘটে দুই আরব যাদুকরের। এদের আগমনের মধ্য দিয়েই কাহিনি গতি পেতে শুরু করে। তারা শুনায় আজন্ম শত্রু দুই উপজাতির গল্প - সাদা কেন্দা আর কালো কেন্দা। সাদা কেন্দার দেবতা শিশু, যার সাথে অদ্ভুত মিল আছে মিশরীয় মহান দেবশিশু হোরাসের, তার ওরাকল মারা গেছে। দৈবাদেশে সে বলে গেছে নতুন ওরাকল জন্ম নিয়েছে ইংল্যান্ডে। সেই ওরাকল আর কেউ নয় - লুনা ! অন্যদিকে, কালো কেন্দাদের দেবতা এক অশুভ হাতি জেনা যার পৈশাচিকতার সাথে মিল আছে মিশরীয় দেবতা সেট-এর। জেনা এক খুনী হাতি যা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রকান্ড হাতি এবং আশ্চর্যজনকভাবে সে অন্য হাতিদের খুন করে বেড়ায়। অথচ, যুদ্ধের সময় কালো কেন্দাদের নেতৃত্ব দেয়। জেনা শুধু ভয় পায় শিশু নবীকেই।
সাদা কেন্দাদের শিশুদেবতা অনেক শক্তিশালী, কিন্তু ওরাকল না থাকায় তার নির্দেশ পাচ্ছে না সাদারা। ওদিকে সংখ্যায় অনেক বেশি কালো কেন্দারা যুদ্ধের জন্য তৈরি। এখন লুনাকে সাদাদের দরকার। সাথে অ্যালানকেও যুদ্ধের জন্য। পারিশ্রমিক হিসেবে তারা অ্যালানকে সন্ধান দিবে আফ্রিকার সেই গোপন গোরস্থানের যেখানে হাতিরা মৃত্যুর সময় গিয়ে হাজির হয়। হাতির দাঁতের ভান্ডার সেটা।
পুরো ঘটনাটা তাদুকির ধোঁয়ায় দেখতে পায় লুনা এবং অ্যালান দুজনেই। তবে প্রত্যাখ্যান করে আরবদের প্রস্তাবকে। এরপর দুই জাদুকর লুনাকে সম্মোহনের মাধ্যমে কিডন্যাপের চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয় অ্যালানের জন্য। পরে জাদুকররা চলে যায়, অ্যালানও চলে আসে আফ্রিকায়।
অ্যালান আফ্রিকায় বসে খবর পায় রেগ্ন্যাল এবং লুনার বিয়ের। তাদের এক শিশু সন্তান হয় যে অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে সার্কাসের এক পোষ মানা হাতির দ্বারা মারা যায়। লুনা মানসিক ভারসাম্য হারায় এবং পরবর্তীতে মিশরে নিখোঁজ হয়ে যায়। ধারণা করা হয়ে ডুবে গেছে নীল নদে।
এদিকে অ্যালান জড়িয়ে পড়ে এক ইহুদি ঠকের ব্যবসায়। খনির ব্যবসায় তার সর্বস্ব বিনিয়োগ করে এবং তাকে দেখে আরও অনেকেই। পরবর্তীতে জানা যায় সে কোম্পানিটি ভুয়া এবং অ্যালান সহ বিনিয়োগকারীরা সবাই সর্বস্ব খুইয়েছে।
বেঁচে থাকার তাড়নায় অ্যালান আবার শিকারের বন্দুক হাতে তুলে নেয়। গন্তব্য সেই কেন্দাদের হাতিরাজ্য। এসময় দৃশ্যপটে হাজির হন লর্ড রেগ্ন্যাল যিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন লুনা জীবিত আছে কেন্দাদের দেশে।
এভাবেই শুরু হয় এক অদ্ভুত অভিযান - লর্ডের উদ্দেশ্য লুনার খোঁজ, অ্যালানের উদ্দেশ্য হাতির দাঁত আর চিরসাথী হ্যান্সের উদ্দেশ্য রেভারেন্ড বাবার সন্তান অ্যালানের নিরাপত্তা, আর সাদা কেন্দাদের উদ্দেশ্য কালোদের নির্মূল। বিরান প্রান্তর, ধু ধু মরুভূমি, জাদুর মায়াজাল, অতিপ্রাকৃত শক্তির জেনা, শিশুদেবতার মন্দির, অভিশাপ, বহু প্রাচীন মিশরীয় পূজা পদ্ধতি, আর দুই জাতির যুদ্ধের কাহিনি এটি।
অবশেষে সত্যিই মুখোমুখি হয় দুই জাতি, যে যুদ্ধে অ্যালানের অভাব নেই বন্দুকের, কিন্তু অভাব আছে গুলির। অভাব নেই যোদ্ধার, কিন্তু অভাব আছে দক্ষতার। এক অসম যুদ্ধ যেখানে প্রতিপক্ষে যোদ্ধা প্রায় বিশ গুণ বেশি এবং নেতৃত্বে আছে এক খুনী হাতি ! এ যুদ্ধ অ্যালানের জীবনের সবচে বড় ক্ষতির যুদ্ধ, সর্বস্ব হারানোর মত যুদ্ধ।
হ্যাগার্ডের এ কাহিনিতে অ্যালানের চাইতে অনেক বেশি ভূমিকা হ্যান্সের। বীরত্ব, সাহস, প্রভুপ্রেম সব মিলিয়ে হ্যান্স এ বইতে এক অন্য চরিত্র। বরং অ্যালানের চরিত্র অংকনে হ্যাগার্ড অনেক মানবীয় দোষ দেখিয়েছেন যেখানে ঈর্ষা-ব্যর্থতা-হতাশা বারবার ঘিরেছে অ্যালানকে।
সব মিলিয়ে টানা পড়ে ফেলার মত কাহিনি "দি আইভরি চাইল্ড"। অনুবাদও সুখপাঠ্য। তবে লেখকের নাম প্রচ্ছদে এবং পাতা উল্টালেই দুরকম - এটা দৃষ্টিকটু ( হ্যাগার্ড / হেগার্ড )। সেবার বইতে যেহেতু মুদ্রনপ্রমাদ প্রায় অনুপস্থিত থাকে, এটা তাই চোখে লাগে।
"সেবা" প্রকাশিত একশ চব্বিশ টাকা দামের ৪১০ পৃষ্ঠার বইটি "বইপোকা"দের ভাল লাগবে।
0 Comments