বই- দূরবীন
*লেখক- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
*প্রকাশক- আনন্দ পাবলিশার্স
*প্রকাশকাল-১৯৮৬
*পাতার সংখ্যা-৬১৬
*মূল্য-৮০০/=( কোলকাতা প্রিন্ট)
রিভিইউ লিখেছেন: নাদিম সাইফুল
|
দূরবীন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় |
বড় বইয়ের রিভিউ লিখা আসলেই খুব কঠিন। রিভিউ ছোট হলে মনে হয় কিছু বাদ পড়ে গেলো আর বড় হলে মনে হয় বিরক্তিকর তবুও চেস্টা করলাম। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
বইটাতে একই সাথে পাশাপাশি একটা বংশের তিন প্রজম্মের পুরুষদের জীবনগাথা বর্ননা করা হয়েছে। যাদের প্রতি প্রজম্মের পুরুষের জীবনেই যেন রয়েছে অস্বাভাবিকতা। এক প্রজম্মের প্রতি অন্য প্রজম্মের যেমন রয়েছে প্রবল ভালোবাসা তেমনি রয়েছে চরম ঘৃণা। এত কিছু সত্তেও জীবন যাপনের তাগিদে একই সাথে বেড়ে ওঠার চিত্র গুলো বইটাতে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথম পুরুষ- জমিদার হেমকান্ত চৌধুরি। ছয় সন্তানের জনক অল্প বয়সে বিপত্নীক। স্ত্রী মারা গেলে সংসারের প্রতি আর তেমন কোন টান অনুভব করেননি বিধায় দ্বিতীয়বার আর বিয়েশাদি করেননি। একেবারে ছোট ছেলেমেয়ে বিশাখা আর কৃষ্ণকান্ত তার কাছে থাকে। তার কাছে থাকলেও মানুষ হচ্ছে রঙ্গময়ীর কাছে। রঙ্গময়ীকেই মায়ের মত জানে রঙ্গময়ী ছোটবেলা থেকেই এই বাড়িতে মানুষ তাকে ঠিক কাজের লোকও বলা চলেনা। হেমকান্তদের দুর সম্পর্কের আত্মীয়া, বিয়েশাদি করেনি। হেমকান্তের চাইতে বয়সে ১০-১৫ বছরের ছোট হবে। এই রঙ্গময়ীই হচ্ছে হেমকান্তের সাথে সংসারের যোগাযোগের একমাত্র সুত্র। তার কাছ থেকেই ছেলেমেয়ের খোজ খবর নেন হেমকান্ত। আবার তার কাছেই নিজের সব কথা খুলে বলেন। হঠাৎ একটা ঘটনার কারনে হেমকান্ত শেষ বয়সে এসে আবারো যেনো জীবনের প্রতি টান অনুভব করেন এবং রঙ্গময়ীর আরো কাছাকাছি আসতে থাকেন। গ্রামে গুজব চলতে থাকে হেমকান্ত আর রঙ্গময়ী কে জড়িয়ে। বড়বড় ছেলেমেয়েরা লজ্জায় পড়ে যায় বাবার এই ভীমরতির খবর শুনে। এক সময় ছেলেমেয়েরা এসে ঘোষণা দেয় বাড়ি ছাড়া করতে হবে রঙ্গময়ীকে।
দ্বিতীয় পুরুষ - জমিদার কৃষ্ণকান্ত। জমিদার হেমকান্ত চৌধুরির একেবারে ছোট সন্তান। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ায় মাতৃসম পিসি রঙ্গময়ীর কাছে মানুষ। ছোট থেকেই দেখে এসেছে বাবা খুব গম্ভীর ধরনের মানুষ। এবং সংসার থেকে দূরে সরে থাকতেন। তাই কখনো বাবাকে কাছে থেকে জানার সুযোগ পাননি। হঠাৎ করে একদিন কৃষ্ণকান্তের বাবা হেমকান্ত, ছেলেকে ডেকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে তাকে পড়ালেখার খোজ নেয়া শুরু করেন নিয়মিত শরীর চর্চা শেখাতে থাকেন। হেমকান্ত যেন বাবাকে নতুন করে আবিস্কার করে। ছোটবেলা থেকে মায়ের শাসন ছাড়া মানুষ কৃষ্ণকান্ত। হটাৎ করে বাবার উপদেশ যেন জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায় । আচমকা একদিন কৃষ্ণকান্ত বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে স্বদেশীদের দলে নাম লেখায়।
তৃতীয় পুরুষ - ধ্রুব চৌধুরি। সাবেক জমিদার কৃষ্ণকান্ত চৌধুরির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। ধ্রুবকে আর জমিদার বলা চলেনা এতদিনে জমিদারি পাট চুকে গেছে। তার বাবা কৃষ্ণকান্ত চৌধুরি সাবেক স্বদেশী আন্দোলনের নেতা। এখন স্বাধীন ভারতের রাজনীতির খুব বড় মাপের একজন নেতা। নেতাকর্মীরা সবাই কৃষ্ণকান্তকে নিজের আদর্শ হিসেবেই মানে। একমাত্র ব্যাতিক্রম হচ্ছে ছোট ছেলে ধ্রুব চৌধুরী। ধ্রুব এমনিতে শিক্ষিত,স্মার্ট মানুষ হিসেবে যথেস্ট ভালো। কিন্ত বাবার উপর জেদ করে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকে, পুলিশের সাথে মারামারি করে। বাবার মান সম্মান নষ্ট করার যথাসাধ্য চেস্টা ধ্রুব করে যাচ্ছে। কৃষ্ণকান্ত ছেলেকে মানুষ করার চিন্তা করে বিয়ে করান। ধ্রুব বউয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। বাবার নাম দেখলেই ধ্রুব প্রকাশ্যে গালিগালাজ করে মহান এই নেতাকে।এক আজম্ম রাগ যেন মনের মধ্যে লালন করে চলেছে বাবার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত নেন স্টেট মিনিস্টার কৃষ্ণকান্ত চৌধুরি।
জমিদার হেমকান্ত আর রঙ্গময়ীর সম্পর্কের শেষ পরিনতি কি? হেমকান্ত কি রঙ্গময়ীকে গ্রহন করেছিলো? নাকি সমাজের চাপে পরে পরিত্যাগ করেছিলো? জমিদার কৃষ্ণকান্তের বাড়ি থেকে পলায়ন করে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারন কি? সেও কি বাবার সাথে মাতৃসম রঙ্গময়ী পিসিকে সহ্য করতে পারছিলোনা? দেশের সমগ্র মানুষ যেখানে শ্রদ্ধা করে মহান নেতা, কৃষ্ণকান্ত চৌধুরিকে, সেখানে ছেলে হয়ে ধ্রুবর কিসের এত রাগ বাবার বিরুদ্ধে? কি সেই কারন যার কারনে বাবাকে কখনো বাবা বলে একবারের জন্যও ডাকেনা ধ্রুব? কৃষ্ণকান্ত চৌধুরি অবশেষে কি এমন সিদ্ধান্ত নেন? সব গুলো প্রশ্নের জবাব পেতে হলে পড়তে হবে বইটি।
বইটাতে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, যে প্রতিটা কেন্দ্রীয় চরিত্রের সাথেই মেয়েদের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্ত গল্পের নায়কদের থেকে মেয়েদের একটা দুরত্ব বজায় ছিলো। যে জিনিসটা আমার ভালো লেগেছে। তাছারা ধ্রুব চৌধুরীর চরিত্রটা আমার কাছে বিশেষ ভালো লেগেছে। একটা মানুষের ভালোবাসা বা অভিমান থেকে কি পরিমান রাগ জম্মাতে পারে, বইটার ধ্রুব চরিত্র থেকে ভালোই জানা যায়। এছাড়াও এক প্রজম্মের সাথে আরেক প্রজম্মের যে দুরত্ব। সেটা তৈরি হওয়ার কারন বিশদভাবে বর্ননা করা হয়েছে বইয়ে। খাপছাড়া বা অসংলগ্ন কোন বর্ননা নেই। সবগুলো গল্পেরই যেনো একটির সাথে অপরটির সম্পৃক্ততা রয়েছে। সর্বোপরি বইটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে।
0 Comments