Ad Code

Responsive Advertisement

ময়ূরাক্ষীর তীরে PDF

নামঃ ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু

লেখকের নামঃ হুমায়ুন আহমেদ


সাইজঃ ২৮৪ কেবি

মোট পাতাঃ ২৮ টি

বইয়ের ধরণঃ প্রবন্ধ

সিরিজঃ হিমু (Himu)

ফরম্যাটঃ পিডিএফ (PDF)

For Download: Click Here



ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু -হুমায়ূন আহমেদ।


আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি৷ লেকচারার থেকে অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হয়েছি৷ বেতন বাড়েনি, যন্ত্রণা বেড়েছে৷ আমাকে দূর-দূরান্তরে পরীক্ষা নিতে পাঠানো হচ্ছে৷ 

পটুয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর৷ কলেজগুলোতে পড়াশোনা হয় না বললেই চলে৷ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের সুযোগ-সুবিধাও নেই৷ ছাত্ররা কিছুই পারে না৷ অতি সহজ প্রশ্নে মাথা চুলকায়, ঘাড় চুলকায়৷ মাথা এবং ঘাড় থেকে প্রশ্নের উত্তর আসে না৷


অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে এমন ছেলেকে যখন জিজ্ঞেস করি, পানির ফর্মূলা কী? সে আমতা আমতা করে বলে, H2O৷ যেন তার সন্দেহ আছে আসলেই H2O কিনা৷ তারপর জিজ্ঞেস করি, D2O কী? যারা কেমিস্ট্রি জানেন না তাদের বলছি, D2O হচ্ছে হেভি ওয়াটার৷ 

হাইড্রোজেন অ্যাটমে প্রটোন থাকে একটা, এখানে দুটা৷ D হলো হাইড্রোজেনের একটা Isotope৷ অতি সহজ এই প্রশ্নে পরীক্ষার্থী পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে বলে, স্যার হচ্ছে D2O ঢাকার পানি৷ তাহলে রাজশাহীর পানির ফর্মূলাটা কী? স্যার R2O৷ বরিশালের পানি? স্যার B2O৷ বরগুনার পানি? এইবার ছাত্র উৎসাহী৷

 সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে৷ সে হাসিমুখে জবাব দেয়, বরগুনার পানিরও স্যার একই ফর্মূলা B2O৷
আমি হতাশ চোখে পরীক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে থাকি৷ ইন্টারনাল একজামিনার হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, পাস করিয়ে দিতে হবে স্যার৷ গরিবের ছেলে৷ কষ্ট করে লেখাপড়া করছে৷ 

ভাবটা এ রকম যে, ধনীর ছেলেমেয়েদের কেমিস্ট্রি জেনে পাস করতে হবে৷ গরিবের ছেলের পাসটা প্রয়োজন৷ কেমিস্ট্রি জানা প্রয়োজন না৷


বাইরে পরীক্ষা নিতে গেলে ভাইভা বিষয়ক অতি ক্লান্তিকর অবস্থার ভেতর যেতে হয়৷ ছাত্রদের ফেল করাতে ইচ্ছা করে না, আবার পাস করাতেও ইচ্ছা করে না৷ ভাইভা নিতে কষ্ট৷ থাকা-খাওয়াতেও কষ্ট৷


এক্সটারনাল শিক্ষকদের থাকার জায়গা হয় সাধারণত ল্যাবরেটরির লাগোয়া ঘরে৷ উদাহরণ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ৷ 

সেখানে পরীক্ষা নিতে গিয়ে ওই ঘরে অনেকদিন থেকেছি৷ একবার ভূতও দেখেছিলাম৷ যেসব কলেজে এ রকম কোনো ঘর নেই সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয় কোনো শিক্ষকের বাসায়৷

 ভদ্রলোক হয়তো পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করছেন, সেখানে মূর্তিমান উপদ্রবের মতো অচেনা অজানা একজন মানুষ থাকতে আসেন৷ যাকে আপন করে নেওয়া যায় না, আবার দূরেও ঢেলে রাখা যায় না৷


এক্সটারনাল ভদ্রলোক ইচ্ছা করলেই ভাইভায় প্রচুর ফেল করিয়ে ঝামেলা করতে পারেন৷ একবার কেমিস্ট্রির এক শিক্ষকের বাসায় আমার থাকার জায়গা হলো৷ ভদ্রলোকের বাসায় একটা বাথরুম৷ সেই বাথরুম স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘরের সঙ্গে এটাচড৷ আমার আবার রাতে কয়েক দফা বাথরুমে যেতে হয়৷ 

ভদ্রলোক অবশ্য খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, আমার শোবার ঘরের দরজা খোলা থাকবে৷ আপনার যতবার ইচ্ছা বাথরুমে যাবেন৷ কোনো সমস্যা নেই৷


দীর্ঘ ভূমিকা দিলাম, এখন মূল গল্পে আসি৷ আমি পরীক্ষা নিতে গেছি পটুয়াখালীতে৷ ল্যাবরেটরির পাশের টিচার্স রুমে খাট পেতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ গরমকাল৷ বেশির ভাগ সময় ইলেকট্রিসিটি নেই৷ ফ্যান চলে না৷


প্রথম রাতে একফোঁটা ঘুম হলো না৷ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি৷ রাত তিনটায় মশারির ভেতর থেকে বের হলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে শত শত মশা আমাকে ছেঁকে ধরল৷ আবার মশারির ভেতর ঢুকলাম৷ 

গরমে টিকতে না পেরে আবার বের হলাম৷ মশাদেরকে বললাম, তোমরা যারা এখানে আছ তারাই আমার রক্ত খাও, বাইরে থেকে কাউকে ডেকে এনো না৷ ঘরটাকে আমার মনে হলো হাজতখানা৷ 

এই হাজতে সাতটা রাত পার করতে হবে ভেবে খুবই দমে গেলাম৷ এর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় কীভাবে? হঠাৎ করে মনে হলো একটা নদী কল্পনা করলে কেমন হয়?


নদীর পাড়ে একটা গাছের নিচে আমি বসে আছি৷ উথাল পাতাল হাওয়া নদীর উপর দিয়ে উড়ে আসছে৷ এমন হাওয়া যে আমার সামান্য শীত শীত ভাব হচ্ছে৷ আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মশক বানিহীকে সম্পূর্ণ অগ্রহ্য করে নদী কল্পনা শুরু করলাম৷

 নদীর একটা সুন্দর নামও দিলাম – ময়ূরাক্ষী৷ যারা আমার লেখা পড়ছেন তারা হয়তো পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন না যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার গরম লাগা কমে গেল৷ নদীর প্রবল হাওয়ায় মশারা উড়ে গেল৷ আমার খানিকটা শীত শীতও করতে লাগল৷


এভাবেই তৈরি হলো হিমু, যে যেকোনো অবস্থায় কল্পনার নদী ময়ূরাক্ষীর কাছে চলে যেতে পারে৷ হিমুকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম উপন্যাসটির নাম ময়ূরাক্ষী৷ ময়ূরাক্ষীর হিমু আমি নিজে৷ প্রথম লেখা হিমু বিষয়ক বইয়ে ময়ূরাক্ষী নদী কীভাবে চলে এল, একটু দেখা যাক৷


ছোটবেলার কথা৷ ক্লাস সিক্সে পড়ি৷ জিওগ্রাফি পড়ান মফিজ স্যার৷ তিনি ক্লাসে ঢুকলে চেয়ার-টেবিলগুলো পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে৷ স্যার মানুষটা ছোটখাটো, কিন্তু হাতের থাবাটা বিশাল৷ 

আমাদের ধারণা ছাত্রদের গালে চড় বসাবার জন্য আল্লাহতালা স্পেশালভাবে স্যারের এই হাত তৈরি করে দিয়েছেন৷ স্যারের চড়েরও নানা নাম ছিল – রাম চড়, শ্যাম চড়, যদু চড়, মধু চড়৷


এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চড় হচ্ছর রাম চড়, সবচেয়ে নরমটা হচ্ছে মধু চড়৷ স্যার সেদিন পড়াচ্ছেন – বাংলাদেশের নদ-নদী৷ ক্লাসে ঢুকেই আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এই একটা নদীর নাম বল তো৷

 চট করে বল৷ মফিজ স্যার কোনো প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণের জন্য আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়৷ কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে৷ মনে হয় মাথার খুলির ভেতর জমে থাকা কিছু বাতাস কানের পর্দা ফাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে৷


কী ব্যাপার চুপ করে আছিস কেন? নাম বল৷ আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, আড়িয়াল খাঁ৷ স্যার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলেন৷ খুব সম্ভব রাম চড়৷ হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এত সুন্দর সুন্দর নাম থাকতে তোর মনে এল আড়িয়াল খাঁ? 

সব সময় ফাজলামি? কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক৷ আমি কানে ধরে সারাটা ক্লাস দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ঘন্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক আগে পড়ানো শেষ করে স্যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে আয়৷


আরেকটি চড় খাবার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেলাম৷ তিনি বিষন্ন গলায় বললেন, এখনো কানে ধরে আছিস কেন? হাত নামা৷ আমি হাত নামালাম৷ স্যার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, তোকে শাস্তি দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে, খুবই অন্যায়৷ তোকে নদীর নাম বলতে বলেছি, তুই বলেছিস৷ আয় আরও কাছে আয়, তোকে আদর করে দেই৷


স্যার এমন ভঙ্গিতে মাথায় এবং পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন যে আমার চোখে পানি এসে গেল৷ স্যার বিব্রত গলায় বললেন, আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম, আর তুই বললি আড়িয়াল খাঁ৷ আমার মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে৷ আচ্ছা এখন সুন্দর একটা নদীর নাম বল৷ আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম ময়ূরাক্ষী৷


ময়ূরাক্ষী? এই নাম তো শুনিনি৷ কোথাকার নদী?
জানি না স্যার৷
এই নামে আসলেই কি কোনো নদী আছে?
জানি না স্যার৷


স্যার হালকা গলায় বললেন, আচ্ছা থাক৷ না থাকলে নেই৷ এটা হচ্ছে তোর নদী৷ যা জায়গায় গিয়ে বস৷ এমনিতেই তোকে শাস্তি দিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়েছে৷ তুই তো দেখি কেঁদে কেঁদে আমার মন খারাপটা বাড়াচ্ছিস৷ আর কাঁদিস না।

Post a Comment

0 Comments

Close Menu