বই রিভিউঃ Born to Run : A Hidden Tribe, Superathletes and the Greatest Race the World has Never Seen লেখকঃ Christopher McDougall প্রকাশকালঃ ২০০৯
Book Review: Born to Run : A Hidden Tribe, Superathletes and the Greatest Race the World has Never Seen By Christopher McDougall
রিভিইউ লিখেছেন: ইশতিয়াক আহমেদ
২০০৬ এর গ্রীষ্মের এক ভোর। মেক্সিকোর বুনো পশ্চিমে সিয়েরা পর্বতশ্রেণীর গহীনে দুর্গম কপার ক্যানিয়নের তলানির একমুঠো শহর ইউরিক এর ভাঙ্গাচোরা এক রাস্তা। দুর্গম এজন্য যে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের থেকেও অনেক বেশী বড় এই ক্যানিয়নের শেষ মাথায় পৌঁছতে পৌঁছতে মনে হবে পৃথিবীর একেবারে শেষ মাথায় চলে গেছেন, সেখান থেকে ফিরে আসাও দুরাশা। তো এমনই দুর্গম এক শহরের আধাফাটা রাস্তায় সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে বন্দুকের গুলির শব্দে দৌড় শুরু করার অপেক্ষায় একদল দৌড়বিদ – সম্ভবত বিশ্বের সবথেকে অদ্ভুততম আলট্রা-ম্যারাথন এর জন্য। কারা এই দৌড়বিদেরা? আমেরিকার সবথেকে সফলতম আলট্রারানার থেকে শুরু করে আরো কয়েকজন নামকরা পশ্চিমা দৌড়বিদ যেমন আছে, তেমনি আছে পৃথিবী থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক গোত্রের বাছাই করা কয়েকজন দৌড়বিদ – যে গোত্র সম্পর্কে নির্দ্বিধায় বলে দেয়া চলে তাবৎ দুনিয়ার সবথেকে সেরা দৌড়বিদ তারা – ২দিন টানা দৌড়ে তারা পাড়ি দিতে পারে ৪৩৫ মাইলেরও বেশী; এবং তারপর আবার বেরিয়ে পড়তে পারে তারা! তারা প্রতিনিধিত্ব করে এমন এক সময়ের – যে সময় পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে আজ কয়েক হাজার বছর হতে চললো। কী হবে এই রেসের ফলাফল? আধুনিক পৃথিবীর পোড়খাওয়া আলট্রারানাররা কি পারবে পৃথিবীর বুকে আজ পর্যন্ত পা-ফেলা সবথেকে স্বচ্ছন্দ একদল দৌড়বিদকে হারাতে? নাকি শতাব্দী-প্রাচীন এক গোত্রের সহস্রাব্দ পুরনো কলাকৌশলের কাছে তাদের পরাজিত হতে হবে?
***
অ্যান ট্রেসন। ৩৩ বছর বয়েসী ক্যালিফোর্নিয়ার কমিউনিটি কলেজ শিক্ষক। খুব সাধারণ একজন নারী। ভীড়ের মধ্যে থেকে আপনি যদি তাকে খুঁজে বের করতে পারেন তো হয় আপনি মিথ্যুক নয়তো তার স্বামী! তো হঠাৎ একজন সাদামাটা নারীকে নিয়ে আলাপ কেন? একটা কিছু তো আছেই। এই “একটা কিছু” হলো অ্যান দৌড়াতে খুব ভালোবাসতেন। গ্র্যাজুয়েট স্কুলের প্রতিদিনকার একঘেয়ে মাথাধরানো রিসার্চ কাজে যাবার পথে আর ফেরার সময় প্রায় ৯মাইল “হালকা” জগিং করে যেতেন আর আসতেন। হঠাৎ মন ভালো লাগছে না, তো কয়েকপাক চক্কর দিয়ে আসলেন গোল্ডন গেট ব্রীজ পার্কে। মাঝে মাঝে তো ভূত চেপে বসতো মাথায় রীতিমতো! কোন এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই ধুমধাম জুতো বেঁধে নেমে পড়তেন রাস্তায়। মাইল “বিশেক” (!) দৌড়ে পথে এক জায়গায় থেমে হালকা একটু ব্রেকফাস্ট করে আবার ২০ মাইল দৌড়ে বাসায়! তারপর সারাদিন নিজের ওয়ার্কশপে নাটবল্টু গুঁতিয়ে কাজ করে ঘেমে নেয়ে যখন পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে সারাদিনের কথা ভেবে নিজের উপর খুব সন্তুষ্ট হলেন, রাতের বেলা নিজেকে ছোট একটু “পুরস্কার” দেবার জন্যে আবারো মাইল ১৫ হালকা জগ করে এলেন।
কী ভাবছেন? অ্যান “Superhuman” টাইপের কিছু? নাহ, তেমন কিছু না। বলছি, ধৈ্র্য ধরে একটু সাথে থাকুন কেবল।
তো দৌড়ের প্রতি এমন ভালোবাসা থাকা অ্যানের পক্ষে জাতীয় সব রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলাটাই স্বাভাবিক, তাই না? তা তিনি ভেঙ্গেছিলেনও – কিন্তু তার টার্গেট সবসময় বড়োসড়ো থাকতো। কখনো তিনি ম্যারাথনের মতো “আল্প” পাল্লার দৌড় পছন্দ করতেন না – তার ভালোবাসা ছিলো অনেক বড় দূ্রত্বের প্রতি, যাকে কিনা বলে আলট্রাম্যারাথন; ৫০ মাইল, ১০০ মাইল কিংবা তারো বেশি। সময়কালটা ১৯৯২-৯৩। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবথেকে সেরা নারী আলট্রারানার হিসেবে প্রায় সব রেকর্ডই ভাঙ্গা শেষ অ্যানের। কিন্তু শুধু নামকাওয়াস্তে সেরা হয়ে থাকতে কখনোই চাননি অ্যান। চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করতেন তিনি। আর তাই তো বেছে নিলেন তখন পর্যন্ত তার অধরা – যুক্তরাষ্ট্রের সবথেকে অমানুষিক, নিষ্ঠুর আর প্রায় অসম্ভব ১০০ মাইলের আলট্রাম্যারাথন – কলোরাডো অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত আমেরিকার সবথেকে উচ্চতম শহর লেডভিলে!
লেডভিল বড় বড় পোড়খাওয়া আলট্রারানারদেরই অবস্থা খারাপ করে দেয়। ম্যারাথন শেষ করার আগেই অর্ধেকের বেশি প্রতিযোগী হাল ছেড়ে দেয়। সেখানে একজন নারী আলট্রারানার প্রথম স্থান দখল করে নেবেন – এমনটা ভাবাও ছিলো কল্পনা। কিন্তু ১৯৯৪ এর সেই “লেডভিল-১০০” রেসে সবদিকে ছিলো এমনই গুঞ্জন – অ্যান ট্রেসন এবার বাঘা বাঘা দৌড়বিদদের হারিয়ে দিবেন! প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন অ্যান সেভাবেই – এগিয়েও ছিলেন প্রায় ৯০ মাইল পর্যন্ত! ইতিহাস গড়তে যখন মাত্র মাইল দশেক বাকি, কঠিন পরিশ্রমী অ্যানের যখন প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছে আর চোখ বুজে আসছে অবসাদে – তখনই অ্যান দেখলেন ভোরের আলোধাঁধারির মাঝে – প্রায় অশরীরির মতো আলখাল্লা গায়ে দেওয়া আর চামড়ার হালকা এক চপ্পল পায়ে দেওয়া মেক্সিকোর গহীনের প্রায় ভুলে যেতে বসা এক প্রাচীন গোত্রের এক তরুণ প্রায় হাওয়ার মতো ভেসে যাচ্ছে তাকে অতিক্রম করে! অ্যান অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন প্রায় একদিনের মতো অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে দৌড়ে তিনি যখন তার ক্যারিয়ারের সবথেকে বড় অর্জনটা থেকে আর মাত্র ১০ মাইল দূরে এই তরুণকে দেখে তার মাথায় একটা কথাই আসলো – “He didn’t even look tired! It’s like he was just…having fun!” ভেঙ্গে পড়লেন অ্যান। প্রায় ৯০ মাইল পর্যন্ত পথ এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে দৌড় শেষ করলেন। আর সেই মেক্সিকান তরুণ – প্রথম! শুধু সেটাই না – তার গোত্রের আরো ৬জন, হ্যাঁ, ৬জন প্রতিযোগী জায়গা করে নিলেন প্রথম ১০ জনের মধ্যে! অবিশ্বাস্য! আমেরিকার সবথেকে কঠিনতম আলট্রাম্যারাথন অবাক হয়ে দেখলো বিশ্বের সবথেকে সেরা আলট্রারানারদের! সেই শেষবার – সেই শেষবার বিশ্ব দেখতে পেলো তাদের। হারিয়ে গেলো তারা এরপর, পশ্চিমী বাণিজ্যিকীকরণের নোংরা বলয় কাছ থেকে দেখায় ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিয়ে হারিয়ে গেলো তারা – তাদের মেক্সিকোর দুর্গম সেই কপার ক্যানিয়নের অভ্যন্তরে; অনেক বছর যাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি পরে আর। দৌড় আর জীবন যাদের কাছে সমার্থক – নিঃসন্দেহে সারা পৃথিবীর সবথেকে সেরা সেই দৌড়বিদ জাতি প্রায় হারিয়ে যেতেই বসেছিলো ইতিহাসের পাতা থেকে। মহৎহৃদয় এক শ্বেতাঙ্গের কারণে আবার তারা ফিরে এলো সবার সামনে – রাজী হলো তাদেরই পবিত্রভূমিতে পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকজন সেরা দৌড়বিদদের সাথে এক অসাধারণ দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে, যার কথা শুরুতেই বলেছি। কারা এই গোত্র , যাদের কথা এতো বলছি? সে গোত্রের নাম তারাউমারা (Tarahumara)। তাদেরকে নিয়েই এই বই – এবং শুধু তাদেরকে নিয়েই না, এতে আছে বিশ্বের সবথেকে ব্যাপক কমিটিটিভ স্পোর্ট দৌড় বা রানিং এর ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সব মজার মজার ঘটনা, প্রেরণামূলক অনেক কাহিনী আর দৌড়ানোর প্রতিটা খুটিনাটি বিষয়ের ইন্টারেস্টিং আর চুলচেরা সব বিশ্লেষণ!
*** আমরা দৌড়াই কেন? কারণ দৌড়ানো আমাদের জন্য অপরিহার্য ছিলো – যখন আমরা সেই গুহামানব ছিলাম! আমরা এই গ্রহে বেঁচে আছি আর বিস্তার লাভ করেছি এই দৌড়ের জন্যই। আমরা খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য যেমন দৌড়েছি, তেমনি অন্য কারো খাবার না হবার জন্যও দৌড়েছি! সঙ্গী খুঁজে পাবার জন্য দৌড়েছি, তাকে পটানোর জন্য দৌড়েছি আবার তাকে নিয়ে ভেগে যাবার সময়ও দৌড়েছি! দৌড়ানোকে আমাদের ভালোবাসতেই হত, কারণ তা না হলে আর কিছুকে ভালোবাসার জন্য আমরা বেঁচে থাকতাম না! আমরা যেমন দৌড়ানোর জন্যই জন্মেছি – তেমনি আমদের পূর্বপুরুষরা না দৌড়ালে হয়তো আমরা জন্মাতামই না!
দৌড় নিয়ে তো অনেক স্তূতি হলো – এবার চলে আসি বর্তমান বিশ্বের দৌড়ের রকম আর দৌড়বিদদের মানসিকতা নিয়ে। অলিম্পিক-ম্যরাথন-আলট্রাম্যারাথন এর যুগে দৌড় যত মানুষের ভালোলাগার আর প্যাশনের একটা স্পোর্ট – তার থেকে বেশি অর্জন, সাফল্য আর পয়সার এক মনোপলি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৌড়বিদরা টাকা-পয়সা-যশের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ভুলে গেছেন যে একটা স্পোর্টের প্রতি ভালোবাসা কিংবা প্যাশন না থাকলে বেশিদিন সেই স্পোর্টকে ব্যবহার করে ব্যাবসা করা যায়না!
সবাই যে একই রকম সেটা কিন্তু না – ব্যতিক্রমও আছেন বৈকি! একজনের কথা না বললেই না – এমিল জাটোপেক। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত চেকোস্লোভাকিয়ার মিলিটারি বাহিনীর একজন সৈ্ন্য। মিলিটারি একাডেমীর সারাদিনের কঠোর ট্রেনিং-এর পর সবাই যখন সন্ধ্যা না হতেই শ্রান্ত হয়ে ঘুমে তলিয়ে পড়ছে, তখন সেই এমিল জাটোপেক একটা মলিন কেডস পায়ে দিয়ে রাত বিরাতে জংগলের মাঝখান দিয়ে দৌড়াতে বের হয়ে পড়তেন। ভালোবাসতেন তিনি এই স্পোর্টটাকে। তাই বলে যে অর্জন আসেনি তার তা কিন্তু নয়!
১৯৫২ সালের হেলসিংকি অলিম্পিক। চেক দলের খুবই করুণ অবস্থা, অ্যাথলেট প্রায় নেই বললেই চলে! হাতেগোনা কয়েকজনের মাঝে এমিল একজন। মোটামুটি অ্যাথলেটিক্সের সবগুলো ইভেন্টেই নাম দিয়ে ফেললেন। ৫০০০মিটার এ স্বর্ণ পেয়ে গেলেন ধুম করেই। সবাই অবাক। তার একটা প্রধান কারণ তার দৌড়ানোর স্টাইল। তার দৌড়ানো দেখলে সবার মনে হত কেউ তার বুকে একখানা ছুরি বসিয়ে দিয়েছে সাঁই করে আর তিনি চোখ-মুখ খিঁচিয়ে আক্রমণকারী থেকে পালানোর জন্য জীবনবাজি রেখে ছুটছেন! সবাই হাসাহাসিও করে নিতো বেশ একচোট। তবুও সেই ভয়বাহ রানিং টেকনিক নিয়েও যখন তিনি ১০০০০ মিটার এও স্বর্ণ পেয়ে একই অলিম্পিকে দ্বিতীয় স্বর্ণ জিতে গেলেন – তখন সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। ব্যাপার কী? এই লোক করছেটা কী? তখনো ২৬.২ মাইলের ম্যারাথন ইভেন্ট বাকি। এমিল জাটোপেক আগে কখনো ম্যারাথন দৌড়ানই নি। তো যাই হোক ম্যারাথন শুরু হয়ে গেলো। সবার আগে ম্যারাথনে তখনকার ওয়ার্ল্ড-রেকর্ডধারী ব্রিটিশ অ্যাথলেট জিম পিটার্স; আর তার পরে? সেই এমিল জাটোপেক! অর্ধেক পথ পেরোনোর পর পিটার্স আর জাটোপেকের মধ্যে কথা হলো।
জাটোপেক জিগ্যেস করলেন, “জিম, , আমি আগে কখনো ম্যারাথন দৌড়াইনি। তোমার কি মনে হয়? আমরা কি বেশী জোরে যাচ্ছি?” ধুরন্ধর জিম এর জবাবে বললেন, “না এমিল, আমরা আসলে খুবই ধীরে যাচ্ছি!” জিম জানতেন তারা ম্যারাথনের স্পিড অনুযায়ী যথেষ্ট জোরে যাচ্ছেন, কিন্তু তাও তিনি আশা করেছিলেন, পথ যেহেতু এখনো অর্ধেকের বেশি বাকি, এমিল জাটোপেক যদি এখন এর থেকেও বেশী জোরে যেতে শুরু করেন, তাহলে একটু পরই তিনি হাঁপিয়ে যাবেন আর পেছনে পরে যাবেন। তখন জিম টুক করে এগিয়ে থেকে আরেকটা অলিম্পিক স্বর্ণ বগলদাবা করে নেবেন। কিন্তু তিনি ভুল মানুষকে ঠকাতে চেয়েছিলেন। এমিল জাটোপেক কি জিনিস তা তিনি তখনো বুঝে ওঠেননি!
এমিল জিমের কথামতো আরো জোরেই দৌড়েছিলেন। কিন্তু, হাঁপিয়ে না গিয়ে তিনি খুব সহজেই ফিনিসিং লাইন টাচ করেন, সেই জিম পিটার্সের বেশ অনেকক্ষণ আগেই! এমিলকে কাঁধে নিয়ে নাচার জন্যে চেক টীম ট্র্যাকের কাছে যাওয়ার আগেই কয়েকজন জ্যামাইকান স্প্রিন্টার তাকে কাঁধে তুলে নাচা শুরু করে দেয়! মার্ক টোয়াইন একটা কথা বলতেন, “Let us live so that when we come to die, even the undertaker would be sorry.” এমিল জাটোপেক দৌড়কে ভালোবেসে এমন এক কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন যে যখন তিনি জিততেন, সারা বিশ্ব সেই আনন্দ পালনে শরিক হতো!
তারাউমারারা এই বোধটা হাজার বছর ধরে নিজেদের মাঝে জাগিয়ে রেখেছে বলেই বোধহয়, আজো সারা বিশ্ব তাদেরকে চেনে সবথেকে সেরা দৌড়বিদ জাতি হিসেবে। লেখক তাইতো বলেছেন, “That was the real secret of the Tarahumara: they’d never forgotten what it felt like to love running. They remembered that running was mankind’s first fine art, our original act of inspired creation.”
*** একটা ছোট প্রতারণা আর ২০ বিলিয়ন ডলারের একটা ব্যাবসার সূত্রপাতের কথা এবার একটু বলতে চাই।
আপনি কিভাবে দৌড়ান তা একটু ভেবে দেখতে বলছি। মোটামুটি সবাই ছোটবেলা থেকে যখন দৌড়াতে শেখে তখন তারা একটা সাধারণ নিয়ম মেনেই দৌড়ায়, আপনিও সেভাবেই দৌড়েছেন এবং শতকরা ৮০ ভাগ সম্ভাবনা আজো এভাবেই দৌড়ান। কেন? কারণ সেভাবে দৌড়ানোটাই দৌড়ের স্বতঃস্ফূর্ত কৌশল! কী সেটা? বেশিরভাগ মানুষই দৌড়ানোর সময় পায়ের আঙ্গুলের নীচের বলের মতো জায়গাটা কিংবা মাঝখানের মাংশাসী তালুর উপর শরীরের ভর দিয়ে তারপর সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এতে পায়ের হাঁটু বাঁকা থাকে, এক স্টেপের দূরত্ব কমে যায়, কিন্তু এটা নিরাপদ আপনার পায়ের জন্য। হয়তো একটু ধীরে দৌড়াতে পারবেন এভাবে দৌড়ালে, কিন্তু আপনার পায়ের কোন ইনজুরি হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
এবার আসি আরেকটা দৌড়ের কৌশলের কথায়। এটা এক চতুর লোকের মস্তিষ্কপ্রসূত এক কৌশল। কী সেটা বললেই বুঝে যাবেন। একটু আগে বলছিলাম বেশির ভাগ মানুষই দৌড়ের সময় পায়ের তালু বা আঙ্গুলের নীচের বলের মতো জায়গা দিয়ে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। বিল বাওয়ারম্যান নামের এক লোক সত্তুরের দশকের প্রথমদিকে নতুন এক পন্থা বাতলে দিলেন যা সবধরণের দৌড়বিদকে ব্যাপকভাবে আকৃ্ষ্ট করলো। বিল বললেন, দৌড়ানোর সময় আপনি পায়ের তালু এর বদলে পায়ের গোড়ালি দিয়ে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে যান, এতে করে আপনার হাটু বাঁকবেও খুব কম আর আপনি খুব কম সময়েই বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবেন। বুঝতেই পারছেন সকল শ্রেণীর দৌড়বিদেরা কেন আকৃষ্ট হলেন এই নতুন পন্থায় দৌড়ানোর ব্যাপারে। কিন্তু সময়োপযোগী হলেও এই কৌশলের একটা মারাত্নক ত্রুটি ছিলো। মানুষের গোড়ালির নিচে পুরু কোন মাংসের আস্তরণ বা “কুশনিং” নেই। আপনি গোড়ালির উপর ভর দিয়ে দৌড়ালে দ্রুত আগাবেন ঠিকই, কিন্তু তার জন্য মূল্য দিতে হবে আপনাকে আপনার পায়ের সমূহ ধরণের ইনজুরির মধ্য দিয়ে। করতে চাইবেন তা আপনি?
বিল পথও বাতলে দিলেন, বললেন, আপনারা যদি এমন এক বিশেষ জুতো ব্যবহার করেন, যেটাতে গোড়ালির নিচে আলাদা প্যাডিং থাকবে – তাহলেই হলো। আপনি নিরাপদ! এবার নির্বিঘ্নে দৌড়াতে পারবেন। তখন লোকে রব তুললো, আরে এমন জুতো পাবো কোথায় ভাই? বিল হাসলেন, এবং বছরখানেক পরেই হাজির হলেন নিজের জুতোর কোম্পানি নিয়ে – যেই জুতোর কোম্পানি এখন সারা বিশ্বের সবাই একনামে চেনে!
ইতিহাসে খুব সম্ভবত এই প্রথম একজন উদ্যোক্তা প্রথমে পণ্যের একটা ক্ষেত্র, একটা চাহিদা প্রথমে সৃষ্টি করে নিলেন – আর মানুষ যখন সেই চাহিদায় প্রায় হন্যে হয়ে সবদিক ঘুরছে – তখনই সেই “আকাঙ্ক্ষিত” পণ্য নিয়ে দেবদূতের মত হাজির হলেন।
বলুন তো সেই কোম্পানির নাম কী? হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন, সেই কোম্পানির নাম “Nike”.
*** ২০০৬ এর সেই ভোরে ফিরে আসি! যেখানে মেক্সিকোর একেবারে আদিম গর্ভের মাঝে লুকিয়ে থাকা শহর ইউরিকের ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় দৌড় শুরুর অপেক্ষায় সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন পশ্চিমা একদল বাঘা বাঘা আলট্রারানারদের সাথে সাথে শতাব্দীপ্রাচীন একদল আলখাল্লা পড়া তারাউমারা দৌড়বিদ। কিন্তু সেই আলট্রাম্যারাথনের কোন স্পনসর নেই, কোন ESPN বা অন্য কোণ চ্যানেলের ব্রডকাস্টিং নেই, নেই কোন সংক্ষিপ্ত পোশাকের চিয়ারলীডারও। বরং আছে পৃথিবীর আদিমতম আর সরলতম কিছু মানুষ – ইউরিকের বাসিন্দারা। তাদের কলরবে কপার ক্যানিয়নের এই অংশটা গমগম করছে পুরোটা। বন্দুকের গুলির শব্দে হঠাৎ নীরব হয়ে গেলো সব শোরগোল। শুরু হয়ে গেলো বিশ্বের সবথেকে অদ্ভুততম এই আলট্রাম্যারাথন! যে জিতেছিলো সেই রেসে? জানতে হলে পড়তে হবে রানিং তো বটেই, তথা সব ধরণের স্পোর্টস নিয়ে লেখা বইয়ের মধ্যেই অন্যতম সেরা এই বই। না পড়লে মিস করবেন অ-নে-ক কিছু, শুধু একথা বলে দিতে পারি!
লেখকঃ Christopher McDougall একাধারে “Men’s Health”, “Runner’s World”, “The New York Times” এর Athletics আর Sports এর একজন নিয়মিত প্রতিবেদক। প্রথম জীবনে কয়েকদিন War Correspondent হিসেবেও কাজ করেছেন। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে তার যে পরিচয়টা তার লেখনীকে আরো ক্ষুরধার আর সত্যনিষ্ঠ করেছে, তা হল তিনি নিজেই একজন নামকরা আলট্রারানার/দৌড়বিদ। বেশ কিছু ম্যারাথন আর আলট্রাম্যারাথন দৌড়েছেন এর মধ্যেই। বইয়ের সেই তারাউমারাদের সাথে বিখ্যাত সেই রেসে তিনি নিজেও অংশ নিয়েছিলেন! Born to Run : A Hidden Tribe, Superathletes and the Greatest Race the World has Never Seen By Christopher McDougall Documentary
0 Comments