'বাবুর হোটেলে কি কাজ আছে? রসুয়ে-বামুনের কাজ জানি আজ্ঞে।' 'নাম কি?' 'আজ্ঞে হাজারি দেবশর্মা, উপাধি চক্রবর্তী।' 'বাড়ি কোথায়?' 'এড়োশালা গ্রামে বাবু।' 'তিন দিন এমনি রাঁধো - তার পর সাত টাকা মাইনে দেবো আর খেতে পাবে।' সেই যে পাঁচ বছর আগে বেচু চক্কোত্তির রাণাঘাটের ভাতের হোটেলে রান্নার কাজ নিয়েছিল হাজারি ঠাকুর, সেখানেই আছে। মা'র কাছে রান্না শিখেছিল, বলতে নেই রাঁধে সে বেশ ভালোই৷ তার হাতের মাংস কি নিরামিষ চচ্চড়ি যে খেয়েছে, এই হোটেলে ফিরে আসবেই। খদ্দেরদের মধ্যে তার বেশ সুখ্যাতি থাকলেও হোটেল মালিক তার স্বীকৃতি দেয় না। বেতন বাড়েনি এক আনাও, পান থেকে চুন খসলে মাইনে কাটা যায়, আর প্রতিদিন অপমান গঞ্জনা তো আছেই। বেচুবাবুর হোটেলের তদারকি করে পদ্ম ঝি, বাবুর সাথে তার সম্পর্কটা নিয়ে অনেক কানাঘুঁষা আছে। তবে বাবু যে পদ্ম ঝির ব্যাপারে অন্ধ সে সবাই জানে, ঝি যা খুশি বলে, হোটেলের কলাটা মুলোটা তার ঘরেই যায়। পদ্ম ঝি হাজারিকে দেখতে পারে না দু'চোখে, উঠতে বসতে কথা শোনায়। যা কিছু দোষঘাট হয় হাজারির ঘাড়েই চাপিয়ে দেয়। হোটেলে খদ্দের ঠকানোর হাজারটা ফিকির আছে। কখনো পঁচা মাছ ভেজে দিতে হয়, ডালে ফেন মেশানো, বাসি ভাত, নষ্ট দই এসব পরিবেশন করতে হাজারি ঠাকুরের মন সরে না। কিন্তু পদ্ম ঝির চোখ রাঙানিতে বাধ্য হয়েই করতে হয়। দুপুরে উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে একটু ফুরসত পেলে চূর্ণী নদীর ধারে গিয়ে বসে যখন, হাজারি ঠাকুর বিভোর হয় নিজের একটা ভাতের হোটেলের স্বপ্নে। যে হোটেলে খদ্দের ঠকানো হবে না, থাকবে হাজারি ঠাকুরের আন্তরিকতা আর রান্নার জাদু। কত আশা, কত পরিকল্পনা! কিন্তু হোটেল খুলতে কি কম টাকা লাগে? মাস শেষে গ্রামে স্ত্রী কন্যাকে টাকা পাঠিয়ে কি-ই বা রয়। তাতে নিজের ব্যবসা করা যায় না! এদিকে বেচু চক্রবর্তীর হোটেলের দুর্নীতি আর দুর্ব্যবহারও দিন দিন বেড়ে চলেছে। হাজারি বামুন কি পারবে তার স্বপ্নের 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' - কে সত্যি করতে? পাঠপ্রতিক্রিয়া: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিখ্যাত উপন্যাস 'আদর্শ হিন্দু হোটেল'। কপটতা আর অপমানের জবাবে সহজ সরল ভালোমানুষি দিয়ে হাজারি ঠাকুরের এগিয়ে চলার গল্প এটা। সেইসাথে সৎ থেকে স্বপ্ন দেখে অটুট লক্ষ্যে পৌঁছানোর অনুপ্রেরণাও হতে পারে হাজারি ঠাকুর। গল্পে প্রথম থেকেই হাজারি ঠাকুরের চরিত্রটি পরিষ্কার, নীতিবান সৎ মানুষ সে। কিছুটা গরীরের আজন্ম লালিত ভীতিও তার মধ্যে রয়েছে, যার কারণে অবিচারের প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু যোগ্যতা যার আছে, সেই হীরের দ্যুতি ঠিকই ছড়িয়ে যায়। হাজারি ঠাকুরের জীবনে স্নেহ-মমতার চাদর বিছিয়ে দেয় কুসুম - অতসীর মত কন্যাসম চরিত্রগুলো৷ নিঃস্বার্থভাবে যারা নিজের অর্থ ঠাকুরের হাতে তুলে দেয়৷ ভালো ব্যবহারের বিনিময়ে মানুষ ভালোটাই পায়, এমনটাই দেখাতে চেয়েছেন লেখক। ভাতের হোটেলের খুঁটিনাটি পড়তে দারুন লাগে। হোটেলের জীবনযাত্রা, বাজার সদাই, স্টেশনের যখন যাত্রীরা এসে নামে, তাদের খাওয়ানো, কোলাহল সবকিছুর মধ্যে একটা উত্তেজনা বোধ করছিলাম। পদ্মঝি প্রথম থেকেই তার সাথে খারাপ আচরণ করে। মিথ্যে চুরির দায় চাপায়, নিজে অন্যায় করে হাজারিকে দোষী বানায়, কুসুমকে জড়িয়ে কুকথা বলে। কিন্তু এক সময় পদ্ম যখন বেচুবাবুর হোটেলের সঙ্গে তার সম্পর্কটা হাজারিকে জানায় তখন পদ্মর উপরেও আর পাঠকের রাগ থাকবে না। হাজারি ঠাকুরের যখন দুর্দিন, তখন কাজের খোঁজে সে ভবঘুরের মতো হেঁটে বেড়িয়েছিল গ্রামে গ্রামে। অনেকে তাকে গরীব বামুন হিসেবে খাইয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল। পরবর্তীতে সফল হাজারি আবার সেই পথে, সেইসব চরিত্রের সাথে পুনরায় দেখা হওয়ার অংশটা ভালো লেগেছে। গল্পে এসেছে নরেন, বংশী, যতীন, যদু বাঁড়ুয্যে, রতন ঠাকুর সহ আরো চরিত্র। তবে চরিত্রগুলোকে বিভূতিভূষণ বড় বেশি সরলীকরণ করেছেন। হাজারির জীবনে উত্থান এর সাথে কিছু পতনও আমি আশা করেছিলাম। এতোটা এক ধারায় গল্পটা বয়ে যাওয়াটা একটু একঘেয়ে ছিল। বাস্তবে মানুষের জীবনে আশা-নিরাশা সব মিলেমিশেই চলতে থাকে। নতুন সময়ের পাঠক যারা তাদের কাছে বইয়ের ভাষা একটু অসহজ মনে হতে পারে। তবে গল্পে একবার মিশে যেতে পারলে সেটা অতিক্রম করে নিতে পারবেন। হাজারি ঠাকুরের গল্পটি একজন খেটে খাওয়া অধ্যবসায়ীর কথা। নিজের সততা এবং লক্ষ্যজয়ের তাড়নার জোড়ে যে সফলতার শিখরে পৌঁছানো সম্ভব এবং কর্মের মাধ্যমেই সকল অপমানকে জবাব দেওয়া যায় - সেটাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই গল্পের মূল বার্তা ছিল।
0 Comments