বই: ইনফার্নো
লেখক-ড্যান ব্রাউন
অনুবাদ- মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
ধরন- থ্রিলার
প্রকাশনী- বাতিঘর
পৃষ্ঠা: ৫২৮
ইনফার্নো হচ্ছে রবার্ট ল্যাংডনের সিরিজেরি চতুর্থতম বই। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে।বই প্রকাশের পর প্রথম ১১ সপ্তাহ টানা বেস্ট সেলিং বই ছিল ইনফার্নো।
-
রিভিউ: হার্ভার্ড প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন জ্ঞান ফিরে পেয়ে নিজেকে বাড়ি থেকে হাজার মাইল দূরে ইতালির ফ্লোরেন্সে আবিষ্কার করে। কীভাবে সে পৌঁছুল ওখানে, কোনো ধারণাই নেই তার; ডাক্তাররা তাকে জানায় সাময়িক এমনেশিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে সে। গত কয়েকদিনের কোনো ঘটনাই তার মনে নেই। বিভ্রান্তি চরমে পৌঁছে যখন ল্যাংডন দেখতে পায়, হাসপাতালে তাকে মারতে গুলি চালায় এক নারী আততায়ী। কর্মরত ডাক্তার সিয়েনা ব্রুকসের সাহায্যে প্রথম বিপদটা কাটিয়ে উঠে।
স্মৃতিভ্রষ্ট ল্যাংডনের মাথায় তখন একটি শব্দই প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। তা হলো, ‘খুজলেই পাবে।’ খুজতে গিয়ে তার প্রিয় ঘড়ি মিকি মাউসটাকে পেলো না। তার বদলে জামার পকেটে পাওয়া যায় অদ্ভুত আর ভীতিকর একটি জিনিস। এটা কিভাবে তার কাছে এলো সে সম্পর্কেও সে কিছু জানে না। প্রচন্ড ব্যথায় তিনি বুঝতে পারলেন মাথায় কোন অপারেশান করা হয়েছে। কি হয়েছে, কেন হলো, কিভাবে হলো এর পিছনে কে বা কারা আছে এসব কিছুই যখন গুলিয়ে যাচ্ছে, গোঁদের উপর বিষফোড়ার মতো তার উপর হামলা চালায় আবারো। পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের জন্য ফোন করেন তার এসেম্বিতে। কিন্তু সেখান থেকেও সাহায্যের বদল আসে অন্য কিছু। এ অবস্থায় রবার্টের কাছে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। এরপর ঘটতে থাকে একের পর পর এক আতঙ্কিত ঘটনা।
এদিকে
তার জ্যাকেটে পাওয়া বায়োহ্যাজার্ডের
চিহ্নযুক্ত অদ্ভুত সিলিন্ডার প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় তার সামনে, এর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে এক প্রজেক্টর যাতে দেখা মেলে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী বত্তিচেল্লির চিত্রকর্ম। আরো কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয়ে ল্যাংডন বুঝতে পারে, সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি আছে ইতালির মধ্যযুগীয় কবি দান্তে অলিঘিয়েরির কাছে।
সিয়েনাকে নিয়ে ফ্লোরেন্স জুড়ে ছুটে বেড়ায় রহস্যের কিনারা করার আশায়। কিন্তু তাদের পিছনে পড়ে আছে এক আততায়ী এবং অজানা এক সংস্থা। ধীরে ধীরে জানতে পারে সমস্ত ঘটনার পেছনে হাত আছে উন্মাদ কিন্তু মেধাবী বিজ্ঞানী বার্ট্রান্ড জোবরিস্ট, যিনি পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে অভিনব এবং নৃশংস পথ বাতলে দিয়েছিলেন। ল্যাংডন বুঝতে পারে, মানবজাতির অস্তিত্ব হুমকির মুখে আছে, যদি না আত্মহত্যার পূর্বে জোবরিস্টের রেখে যাওয়া ভিডিও এবং ক্লু থেকে আসল রহস্য উদ্ধার করতে পারে। শুরু হয় ধাওয়া,পাল্টা-ধাওয়ার এক ইঁদুর দৌড়। একে একে সেই দৌড়ে যুক্ত হয় রাঘব বোয়ালেরা।
প্লেগ ভাইরাসের ন্যায় এমন একটি ভাইরাস পৃথিবীতে তৈরী হতে চলেছে যা পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষ থেকে ৪ বিলিয়ন মানুষে নিয়ে আসবে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ল্যাঙডন একে থামাতে চায়। কিন্তু ল্যাংডন কী আদৌ পারবে একজন জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে? যে ইঞ্জিনিয়ার একবছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ল্যাঙডনকে যেভাবে প্রত্যেক উপন্যাসে কিছুটা হলেও প্রতারিত হতে হয়, এখানেও কী তাকে সেভাবে কিছুটা প্রতারিত হতে হবে??? নাকি ল্যাংডন পুরো উপন্যাস জুড়েই প্রতারণার স্বীকার হবেন??? এসব কিছুর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে এক রাতের কাহিনী সংবলিত টান টান উত্তেজনাকর এই বই তে।
ইউরোপে-এশিয়ার তিন শহর জুড়ে ল্যাংডনের সেই রোমাঞ্চকর যাত্রার বর্ণনা মিলবে ড্যান ব্রাউনের সর্বশেষ উপন্যাস ‘ইনফার্নো’তে। ড্যান ব্রাউনের সৃষ্ট ‘রবার্ট ল্যাংডন সিরিজ’ এর চতুর্থ থ্রিলার ‘ইনফার্নো’।
ড্যান ব্রাউন, কাহিনীর প্রয়োজন বা শুধু মাত্র ইতিহাস রচনার জন্য হলেও তার কাহিনীর বুনটে অনেকটা দখলদারী থাকে ইতিহাসের। ইনফার্নোতেও আছে তেমনি। বিখ্যাত দুইটা রাজ্যের নাম সহ ইনফার্নোর ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়েছে মানবসমাজের সংস্কৃতি এবং বাস্তব সমস্যাগুলো।
কাহিনীর মোড়ে মোড়ে টুইস্ট এবং অনেক তথ্যবহুল উপন্যাস। লেখক প্রায় সময়েই পাঠককে বেশ কিছুটা ঘোরের মধ্যে রাখেন । ইনফার্নোও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। ড্যান ব্রাউনের অারেক গুন সব কিছুর বিশদ বিবরন।
-
পাঠ_প্রতিক্রিয়া : ড্যান ব্রাউনের আগমন থ্রিলারের জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এক যুগ আগেই। তিনি ধর্ম, সাহিত্য, আর্ট, স্থাপত্য, গুপ্ত সংঘ, আধুনিক প্রযুক্তি, সিম্বলজি প্রভৃতি মিশেলে এক ভিন্ন জনরার থ্রিলার প্রবর্তন করেছেন যা পাঠক আগে কখনো পড়েন নি। তাঁর বইয়ের বিপুল সাফল্যের পেছনে কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করেছে। প্রথমত, ড্যান ব্রাউনের সেই অমূল্য মেধা এবং লেখনী শক্তি আছে যা দিয়ে তিনি পাঠককে তাঁর বইয়ের সাথে সুপার গ্লুয়ের মতো আটকে রাখতে পারেন। আপনার মনে হতে পারে, বইয়ের গল্পটা অবিশ্বাস্য, প্লটটা অদ্ভুত, কিন্তু আপনি একবার তাঁর থ্রিলার পড়া শুরু করার পর মাঝপথে নামিয়ে রাখতে পারবেন না; শেষটা জানার জন্য আপনি পড়ে যেতে একপ্রকার বাধ্য।
ইনফার্নো’ পড়ার সময় কিছু কিছু জায়গায় আমার মনে হয়েছে, লেখক অতিরিক্ত ড্রামা এবং অবিশ্বাস্য পলায়নের বর্ণনা দিচ্ছেন। কিন্তু পড়া থামিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগই পাই নি আমি; কারণ কাহিনী এগিয়ে গেছে রকেটের গতিতে, আর রকেটে সওয়ার হওয়ার পর তা থেকে নামার উপায় নেই যদি না রকেট নিজে থেকেই থেমে যায়।
দ্বিতীয়ত, ড্যান ব্রাউন তাঁর থ্রিলারের স্থানগুলোর বর্ণনা এমনভাবে দেন যে, অভিভূত হয়ে যেতে হয়। তাঁর বর্ণনা পড়ে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি প্লট তৈরি করার জন্য অসম্ভব গবেষণা এবং পরিশ্রম করেছেন। ব্রাউন সাধারণত তাঁর পাত্র-পাত্রীকে ঐতিহাসিক স্থানগুলো পাঠিয়ে দেন। ওইসব ঐতিহাসিক স্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এমনভাবে চোখে সামনে তুলে ধরেন যে পাঠকের মনে হয়-সেও ওই অবিশ্বাস্য যাত্রার একটি অংশ।
ইনফার্নো’তে ইতালির দু’টি এবং ইউরোপ-এশিয়ার সীমান্তে পড়া আরেকটি শহরে ল্যাংডন ও তার সহযাত্রীদের ইঁদুর দৌড়ে বারবারই সামনে চলে এসেছে নানা স্থাপত্য এবং শিল্পকলার নিদর্শন। আর ব্রাউন তাঁর দারুণ বর্ণনায় পাঠককে হতাশ করেন নি।
তৃতীয়ত, ব্রাউন তাঁর বইয়ের মাধ্যমে বিতর্ক উস্কে দিতে ভালোবাসেন। এটি তাঁর থ্রিলারগুলোর অর্থনৈতিকভাবে সফল হবার পেছনে একটি বড়ো কারণও বটে। রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের প্রথম বই- ‘এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস’এর মাধ্যমে ভ্যাটিকানকে চটিয়েছেন, ‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড’ দিয়ে পুরো খ্রিস্টান সম্প্রদায়কেই উত্তপ্ত করে তুলেছিলেন, ‘দ্য লস্ট সিম্বল’ এর মাধ্যমে বড়ো বিতর্কে সূত্রপাত না হলেও আমেরিকার প্রভাবশালী মহলে প্রাচীন গুপ্তসংঘের উপস্থিতি মৃদু গুঞ্জন তুলেছিল। নতুন উপন্যাস ‘ইনফার্নো’তে বিতর্কের জায়গাটা অবশ্য একেবারেই ভিন্ন দিকে। বিজ্ঞানের নৈতিকতার ক্ষেত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্রাউন। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নির্মম সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে নৈতিকতার ক্ষেত্রটি কতোটুকু প্রসারিত তা নিয়ে ইতোমধ্যেই পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞানের জগতে মৃদু আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
ইনফার্নো’ শুরু থেকে রহস্যের চাদরে মোড়া, যখন আমরা দেখতে পারি গল্পের নায়ক বিগত কিছুদিনের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে বসেছে এবং তার পেছনে লেগেছে এক আততায়ী। ব্রাউন তাঁর অন্য উপন্যাস-গুলোয় শুরু থেকেই রহস্যের সূচনা করেন না, ধীরে ধীরে পুরো রহস্য সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু ‘ইনফার্নো’য় পাঠক যেন শুরু থেকে এক রোলার কোস্টার রাইডের মজা পেতে থাকেন। তবে কিছু দুর্বলতা এবং কিছু অদ্ভুত দিক এই থ্রিলারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যেমন- উপন্যাসের শুরু থেকেই মনে হয়েছে ব্রাউন তাঁর উপন্যাসের হলিউডি রূপান্তরের কথা মাথায় রেখেই উপন্যাস লিখতে বসেছেন। একটি টিপিক্যাল হলিউডি চলচ্চিত্রের সাফল্যের জন্য যা যা চাই, তার সবই ভরে দেয়া হয়েছে ‘ইনফার্নো’তে। চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এতে দারুণ খুশি হবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকৃত থ্রিলার পাঠকেরা এতে মনক্ষুণ্ন হয়েছেন।
তাঁর বাকি থ্রিলার-গুলোয় মানবসভ্যতার যে ক্রাইসিস দেখানো হতো, তা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল অবাস্তব; অনেক সমালোচকদের মতে হাস্যকর। কিন্তু এই উপন্যাসে এমন এক সমস্যার সাথে লেখককে যুঝতে হয়েছে যা আমাদের চোখের সামনেই বড়ো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর ক্রম-বর্ধনশীল জনসংখ্যার হ্রাসের জন্য যে বৈপ্লবিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে- তা এই উপন্যাসের মধ্যে জানাতে চেয়েছেন ড্যান ব্রাউন। ড্যান ব্রাউনের থ্রিলার নিয়ে সমালোচকদের মধ্যে নানা ধরনের বিতর্ক আছে; কোনো কোনটি সঠিকও বটে। তবে পৃথিবীর তাবৎ থ্রিলার-প্রেমীকে নতুন ধরনের থ্রিলারের নেশায় ডুবিয়ে দেয়া ব্রাউন সম্ভবত সেই সমালোচনায় খুব একটা ভাবিত নন। তিনি তাঁর মতো করেই একের পর এক লিখে যাচ্ছেন থ্রিলার এবং মানুষের কাছে তা দারুণভাবে সমাদৃত হচ্ছে। একজন থ্রিলার লেখক তাঁর লেখা থেকে এর চেয়ে বেশি আর কী চায়!
-
হ্যাপি রিডিং
পৃ়থিবী হোক বইময় ❤
0 Comments