রিভিইউঃ তেইল্যা চোরা।
লেখকঃ ওবায়েদ হক।
ধরনঃ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস।
পৃষ্ঠাঃ ১১১
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৬০৳
প্রকাশনীঃ বিদ্যানন্দ প্রকাশনী।
রেটিংঃ ৫/৫
মুক্তিযুদ্ধ! মুক্তিযুদ্ধ এমন একটা সময় যখন সবচেয়ে ভীতু মানুষটিও হঠাৎ মহাবীরের মতো সাহসী হয়ে উঠেছিলো। অদম্য সাহসীকতার সাথে তারা দেশমাতাকে রক্ষা করতে নেমে পড়েছিলো এক বৃহৎ মৃত্যুকুপে। তেমনই একজন হলো বলরাম পুর গ্রামের "তেইল্যা চোরা" ফজর আলী। চৌর্যবৃত্তিই তার একমাত্র পেশা।
ছোটবেলা হতে বাবাকে এইভাবেই সংসার চালাতে দেখেছে সে। এছাড়া আর কিছুই পারেনা সে। পারেনা বললে ভুল হবে। আমাদের এই ভদ্র সমাজ তাকে অন্য কাজ করতে দেয় না। কোনো কাজ করতে গেলেই দূর দূর করে তারিয়ে দেয় সবাই। সবাই তার বউ বাচ্চাকে চোরের বউ, চোরের ছেলে বলে আখ্যায়িত করে। কিন্তু সে চায় না তার ছেলেকে কেউ চোরের ছেলে ডাকুক। তার ছেলেও বড় হয়ে তার মতোই হোক। সে তার ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ বানাতে চায়। আর তাই একদিন নিজের ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার গা ছুয়ে দিব্যি খেয়ে নিজের পেশা বদলে ফেলতে চায়। কিন্তু আমারা যে ভদ্রসমাজের মানুষ। এতো সহজেই কি একটা খারাপ মানুষকে ভালো হয়ে উঠতে দিতে পারি? যেদিনই তেইল্যা চোরা তার এতোদিনের পেশা ছেড়ে সৎ পথে গতর খাটিয়ে উপার্জন করার চেষ্টা করলো সেদিনই মিথ্যে চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো! সাড়ে পাঁচ বছরের জেল খাটতে সে চলে গেলো কারাগারে। আর সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় পাগলা প্রফেসর, বাচ্চু,সুজন মাস্টার, ইউসুফ মুন্সী আর নাদির গুন্ডার মতো কয়েকজন ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারার কিছু মানুষের সাথে।
দেশে তখন দানা দিয়ে বেড়ে উঠছে যুদ্ধের পরিস্থিতি। বাঙালি জাতি তাদের অধিকার আদায়ে নির্লিপ্ত। তখন পাকিস্তানিরা বাঙালীদের উপর শুরু করে নির্মম নির্যাতন। জেলখানাতেও চলছে সেই তান্ডব। আর এসব বর্বরতা দেখে তেইল্যা চোরা পরিবর্তন হয়ে তৈরি হলো এক ভিন্ন মানবে। যার রক্তে সবসময় বর্বরতার প্রতিশোধ নেওয়ার বাসনা ছুটে বেড়ায়।জেল থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে চায় সে। কিন্তু কিভাবে পালাবে সেটা বুঝে উঠতে পারে না। পাগলা প্রফেসরের কাছে এই কথা বলে সে।তার সাথে ইউসুফ মুন্সি, সুজন মাস্টার আর বাচ্চুও যোগ হয়।একদিন পাগলা প্রফেসরের সাহায্যে জেল থেকে সবাই পালাতে সক্ষমও হয় তারা। জেল পালিয়ে তারা সবাই একসাথে চলে তাদের নিজেদের গ্রামের উদ্দ্যেশ্যে। কিন্তু সেখানে যে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে এক ভয়ংকরী মূহুর্ত! যা তাদের জীবনকে পুরোপুরি বদলে দেয়। তারা পরিবর্তন হয়ে তৈরি হয় এক ভিন্ন মানুষে।
মূলত, সমাজের চোখে অপরাধী, অবহেলিত কিছু মানুষরা কিভাবে একেকজন যোদ্ধায় পরিণত হলো, সেই গল্পই উঠে এসেছে "তেইল্যা চোরা" উপন্যাসে। এটা শুধু মাত্র একটি মুক্তিযুদ্ধের গল্পই না।এটি এক অবহেলিত তেইল্যা চোরা ফজর আলীর মুক্তি সুজন হয়ে উঠার গল্প। পাকি প্রেমী ইউসুফ মুন্সির নিজের ভুল শুধরে মুক্তিতে যোগ দেওয়ার গল্প। মৃত্যুর আগে 'শালা পাকিস্তানি শুয়োরের বাচ্চা' বলা এক সময়ের পাঞ্জাবি প্রেমী বাচ্চুর গল্পই হলো তেইল্যা চোরা।
সাধারণত অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো থেকে এই গল্পটি একটু ভিন্ন ধাচের। জেল পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান, যা একটু বেশিই কল্পিত আর অবাস্তব মনে হতে পারে। তবে এইটাকে অবাস্তব বলা যাবে না। যশোরের এক কারাগার থেকে কয়েকজন কয়েদীর পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার একটা ঘটনা আছে।
তাছাড়া এই উপন্যাসে যোগ হয়েছে আরেক বাস্তব চরিত্র নাদের গুন্ডা। মুক্তিযুদ্ধের আগে যে ছিলো এলাকার গুন্ডা, সবাই যাকে ভয় পেতো। ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতো। কিন্তু যুদ্ধের সময় সেই কিনা নিজের এলাকাকে পাকিস্তানি মুক্ত রেখেছিলো। এলাকার সবাইকে রক্ষা করতে নিজেকে ঢাল করে তুলেছিলো। অথচ সেই নাদির গুন্ডাকেই কিনা বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানিদের কাছে তুলে দিয়েছিলো।আর খুজে পাওয়া যায়নি নাদির গুন্ডাকে।
ব্যাক্তিগত মতামতঃ তেইল্যা চোরা ১১১ পৃষ্ঠার ছোট একটি বই। এই বইটি শুরু করার পরই এক ঘোরের ভিতর চলে গেছিলাম। বইটি শেষ না করে আর উঠতেই পারিনি।
বইটির প্রতিটি চরিত্রই আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। তাদের চিন্তাধারা, সমাজে টিকে থাকার জন্য তাদের কার্জকলাপ সবগুলোই মন ছুয়ে গেছে।বইটি পড়তে গিয়ে কয়বার যে চশমা ঝাপসা হয়ে গেছে সেটা বলা মুশকিল। কিছু কিছু সংলাপ এতোটাই হৃদয় বিদারক ছিলো যে পড়তে গিয়ে চোখের জল এসে চশমার গ্লাস ঝাপসা করে দিয়ে গেছে।
ওবায়েদ হকের লেখার সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে উনি তার শব্দশৈলী আর বাক্য তৈরির মুন্সিয়ানায় খুব সরল ভাবেই বর্ননা করে যেতে পারেন। তীব্র কষ্ট কিংবা সুখের ঘটনার বর্ণনা উনি খুব সুন্দর করেই দিতে পারেন। তাছাড়া উনার বাচনভঙ্গি আর চরিত্র গঠনের ক্ষমতাও অদ্ভুত রকমের সুন্দর। তিনি এই বইটির চরিত্রগুলোকে এমন ভাবে তৈরি করেছেন যে মনে হয় তারা আমাদের কতোদিনের পরিচিত। তাদের দুঃখ দেখলে মন খারাপ হয়ে যায় আর আনন্দ দেখলে ভালো লাগে।
এই উপন্যাসের প্রচ্ছদটাও উপন্যাসের মতোই সুন্দর। এক গভীরতম অর্থ বহন করে এই প্রচ্ছদ। তেইল্যা চোরা তার ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে চলছে এক গভীর উদ্দেশ্যে! দেশমাতাকে রক্ষা করতে। সে জানে সে মরবে। কিন্তু মরার আগে কয়েকটা পাঞ্জাবী কুত্তা মারতে হবে তার।
0 Comments