Ad Code

Responsive Advertisement

নক্ষত্রের জীবনচক্র - ১ম পর্ব (নীহারিকা থেকে ব্ল্যাক হোল)

নক্ষত্রের জীবনচক্র - ১ম পর্ব 


(নীহারিকা থেকে ব্ল্যাক হোল)
অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত যে বিশাল আলোর এক ছোপ দেখা যায় তার নাম আকাশ গঙ্গা বা মিল্কিওয়ে। আমাদের সূর্য এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরই অন্তর্ভুক্ত খুব সাধারণ একটি নক্ষত্র। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের আওতায় (পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ) দৃশ্যমান মহাকাশে আবিস্কৃত এরকম গ্যালাক্সির সংখ্যা কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন! জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা, দৃশ্যমান এলাকার বাইরে এরকম আরও অন্তত কয়েকশো বিলিয়ন গ্যালাক্সি থাকতে পারে! গ্যালাক্সিগুলোতে ছড়িয়ে রয়েছে নানা ধরণের গ্যাসীয় মেঘ যার মূল উপাদান হাইড্রোজেন (৭০%) ও হিলিয়াম (৩০%) গ্যাস। এছাড়াও সামান্য কিছু অন্য উপাদানও এতে রয়েছে। এই গ্যাসীয় মেঘগুলো একপর্যায়ে যখন অনেক বেশি ঘন হয়ে মহাকাশে ঘন মেঘের এক বিশাল অঞ্চল তৈরি করে, তখন একে বলা হয় নীহারিকা (Nebula)। এই নীহারিকাই মূলত নক্ষত্র তৈরির সূতিকাগার।
নীহারিকার যে অঞ্চলে নক্ষত্র তৈরি হয় তাদেরকে বলা হয় আণবিক মেঘ (Molecular Cloud)। এই আণবিক মেঘ মূলত হাইড্রোজেন অণু দিয়ে গঠিত। হাইড্রোজেন অণুর তৈরি বিশাল আকারের এরকম ঘুর্নায়মান গ্যাসীয় মেঘ একসময় নিজস্ব ভরের কারণে সৃষ্ট মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে সংকুচিত হয়ে ধ্বসে পড়তে থাকে। এই মেঘ যত বেশি ঘন হয়ে সংকুচিত হতে থাকে, এর ভিতরের গ্যাসের অণুগুলোর তত বেশি পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ হতে থাকে, এবং তাদের গতিবেগ তত দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। এই অবিরাম সংঘর্ষ ও গ্যাসের অণুগুলোর দ্রুত হারে বাড়তে থাকা গতির কারণে সেগুলো এত বেশি মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে যে, তখন আর সেগুলো নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি না করে বরং হাইড্রোজেন অণুগুলো পরস্পরের সাথে মিলে পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম অণু তৈরি করতে থাকে। এই বিক্রিয়ার ফলে যে বিপুল তাপ উৎপন্ন হয় সেটা অনেকটা হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরনের মত। উৎপন্ন হওয়া এই বিপুল তাপের কারণেই নক্ষত্রগুলো এভাবে জ্বলতে থাকে। অন্যদিকে এই অতিরিক্ত তাপ নক্ষত্রের ভিতরে গ্যাসের চাপও দ্রুতহারে বৃদ্ধি করতে থাকে। এক পর্যায়ে এই চাপ মাধ্যাকর্ষণ বলের সাথে সমতা আনতে সক্ষম হয়, ফলে গ্যাসীয় অণুগুলোর সংকোচন বন্ধ হয়ে নক্ষত্রটি একটি আপাত সাম্যাবস্থায় উপনিত হয়। নক্ষত্রগুলো এই অবস্থায় থাকে যতদিন না তার হাইড্রোজেন অণুগুলো সম্পূর্ণভাবে হিলিয়ামে অণুতে পরিনত না হয়।
এই অবস্থায় নক্ষত্র তার পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার করে তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে বেশ একটা লম্বা সময়ের জন্য তার নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ বলকে প্রতিহত করে ভারসাম্য রক্ষা করার মাধ্যমে বেশ একটা লম্বা সময় ধরে স্থিতিশীল তাহেক। অবশেষে সাভাবিক নিয়মেই কোন এক সময় সে তার সমস্ত হাইড্রোজেন ও অন্যান্য পারমাণবিক জ্বালানি নিঃশেষ করে ফেলে।
নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় সব হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিনত হওয়ার পর আবারো নক্ষত্র অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে শুরু করে। হিলিয়াম অণুগুলো তখন নিজেদের মধ্যে আণবিক বিক্রিয়া করে আরও ভারী অণু তৈরি করে এবং নক্ষতের প্রয়োজনীয় তাপ উৎপাদন করে। এই ভাবে নক্ষত্রের কেন্দ্রে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমিক ভাবে কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং শেষ পর্যায়ে আয়রন বা লোহা তৈরি হয়। কিন্তু, যেহেতু এই ধরণের পারমাণবিক বিক্রিয়ার জন্য শক্তি প্রয়োজন হয়, নক্ষত্রটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলে কোন পর্যায়ের আণবিক বিক্রিয়া ঘটা সম্ভব তা নির্ভর করে নক্ষত্রটির প্রাথমিক ভরের উপর।
একটি বিষয় আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত শুনতে হলেও সত্যি যে, একটি নক্ষত্র যত বেশি জ্বালানি নিয়ে সৃষ্টি হবে, তত দ্রুত তার জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যাবে। এর কারণ হলো, নক্ষত্রের আকৃতি যত বিশাল হবে, তার মাধ্যাকর্ষণ বলকে প্রতিহত করে নক্ষত্রে সাম্যাবস্থা টিকিয়ে রাখতে তত বেশি তাপের প্রয়োজন হবে। আর যত বেশি তাপ উৎপাদনের প্রয়োজন হবে, তত দ্রুত নক্ষত্র তার পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার করে তা নিঃশেষ করে ফেলবে। যেমন, আমাদের সূর্য একটি মাঝারি ধরনের নক্ষত্র। সূর্যে যে পরিমান জ্বালানি আছে তাতে আরো অন্তত পাঁচ হাজার মিলিয়ন বছর পর্যন্ত সূর্য টিকে থাকতে পারবে, কিন্তু, আরও বিশাল দানবাকৃতির এমন অনেক নক্ষত্র আছে যা মাত্র একশ মিলিয়ন বছরেই তার সমস্ত জ্বালানি নিঃশেষ করে ফেলতে পারে।
নক্ষত্রটি যদি সাধারণ আকারের হলে (যেমন সূর্য) কেন্দ্রীণের হাইড্রোজেন জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে হিলিয়ামে পরিনত হওয়ার পর, বাইরের দিকের অপেক্ষাকৃত হালকা গ্যাসীয় অঞ্চলটিকে ধরে রাখতে পারে না, ফলে ঐ অঞ্চলটি স্ফিত হয়ে প্রসারিত হতে থাকে এবং বিশাল লাল রঙের এক দানবাকৃতি নক্ষত্রে পরিনত হয়, যা “রেড জায়ান্ট বা লাল দানব” হিসেবে পরিচিত। আমাদের সূর্য এমন একটি রেড জায়ান্টে পরিনত হলে তার পরিধি পৃথিবী পেরিয়ে মঙ্গলের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। নক্ষত্র রেড জায়ান্টে পরিনত হওয়ার পর শক্তি উৎপাদনের জন্য তার কেন্দ্রীণের হিলিয়াম অণু ব্যবহার করে আরও ভারী অণু যেমন কার্বণ তৈরি করতে থাকে। কিন্তু এই পর্যায়ে নক্ষত্রটি দীর্ঘ সময় সাম্যাবস্থায় থাকে না এবং এক পর্যায়ে মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে সম্পুর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। তার বাইরের গ্যাসীয় অংশটি তখন একধরনের ছোট গ্রহ-সৃস্টিকারী নীহারিকা বা নেবুলা তৈরি করে, আর ভিতরের অংশ ভীষনভাবে সংকোচিত হয়ে অতি ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের একটি বামনাকৃতি নক্ষত্রে রূপ নেয় যা “White Dwarf বা সাদা বামন” হিসেবে পরিচিত। এরকম একটি সাদা বামনের ব্যাসার্ধ মাত্র কয়েক হাজার কিলোমিটার হতে পারে (পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ৬,৩৭৮.১ কিমি) আর ঘনত্ব হতে পারে প্রতি কিউবিক ইঞ্চিতে কয়েকশ টন পর্যন্ত!
সাধারণ ভরের একটি নক্ষত্রের ক্ষেত্রে সাদা বামনই হলো চুড়ান্ত পরিনতি। মহাকাশে ইতিমধ্যেই এ ধরনের বিপুল সংখ্যক সাদা বামন আবিস্কৃত হয়েছে। এ ধরনের একটি সাদা বামন আকাশের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্র লুব্ধককে (Sirius) কেন্দ্র করে ঘুরছে। এটি একেবারে প্রথমদিকে আবিস্কৃত সাদা বামনদের নক্ষত্রদের মধ্যে একটি। অনেক বিজ্ঞানীর মতে, এই সাদা বামনেরা শীতল হতে হতে এক সময়ে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হবে, যখন এটি আর উল্লেখযোগ্য পরিমানে কোন আলো বিকিরণ করতে পারবে না, ফলে এটি তখন কালো বর্ণ ধারণ করবে। নক্ষত্রের এই পর্যায়কে “Black Dwarf বা কৃষ্ণ বামন” বলা হয়। তবে, কোন নক্ষত্রের এই পর্যায়ে যেতে যে পরিমাণ সময়ের প্রয়োজন হবে, তা আমাদের এই মহাবিশ্বের বয়সের (১৩.৮ বিলিয়ন বছর প্রায়) চেয়ে বেশি। তাই এখনো পর্যন্ত মহাবিশ্বে এ ধরনের কোন কৃষ্ণ বামন সৃষ্টি হয়নি বলে ধরে নেয়া যায়।
কিন্তু, নক্ষত্রটি যদি অতি বড় আকৃতির এবং একটি নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে বড় হয়, তাহলে তাদের পরিনতি হবে অন্যরকম। সেক্ষেত্রে তারা প্রাথমিক অবস্থায় রেড জায়ান্টের আদলে “রেড সুপার জায়ান্টে পরিনত হলেও (যেহেতু তাদের আকার আরও বহুগুন বড়), কিন্তু তার পরবর্তী অবস্থা নাটকীয় রকম ভিন্ন। তখন নক্ষত্রের কেন্দ্রীণের প্রবল চাপে হিলিয়াম থেকে পর্যায়ক্রমে কার্বণ, অক্সিজেন, নিয়ন ও শেষ পর্যায়ে আরও ভারী পদার্থ লোহা বা আয়রন তৈরি হবে। এই সময় অভ্যন্তরে প্রবল পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে নক্ষত্র অতিদ্রুত উজ্জ্বল থেকে আরও উজ্জলতর হতে থাকে এবং একপর্যায়ে প্রবল ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। এই প্রবল বিস্ফোরণ “সুপার নোভা (Supernova) নামে পরিচিত। যখন এই সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে তখন নক্ষত্রটি আগের চেয়ে হাজার কোটি গুণ উজ্জ্বল হয়ে যায়। ১০৫২ সালে চীনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই ধরনের একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ দেখেছিলেন। আমাদের পরিচিত বিখ্যাত ক্র্যাব নেবুলা (Crab Nebula) এই সুপারনোভার ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমান শতাব্দীতে উজ্জ্বলতম সুপারনোভার ঘটে আই.সি.৪১৮২ নীহারিকার ভেতরে একটি নক্ষত্রে। যদিও এই নীহারিকাটি কোটি কোটি নক্ষত্র দিয়ে গঠিত, তবুও এই সুপারনোভার উজ্জ্বলতা সমস্ত নীহারিকার কয়েকশত গুণ বেশি ছিল।

Post a Comment

0 Comments

Close Menu