অন্ধকারে, একলা মানুষ
ঠাট্টা, হাসি, গান, কলরব
যেই থেমেছে, দূরে কাছে
দেখছি পথের সঙ্গীরা সব
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ব্যাপার কী, আর গল্প কি নেই?
রাস্তাটা যে অনেক বাকি।
চোখ তুলে কালপুরুষ দেখেই
ফুরিয়ে গেল সব কথা কি?
সত্যি ছিল সঙ্গীরা? ধুস্।
মধ্যরাতে পথের ধারে
এই তো আমি একলা মানুষ
দাঁড়িয়ে আছি অন্ধকারে।
======
অন্ত্য রঙ্গ
হারে-রে রঙ্গিলা, তোর কথার টানে টানে
পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াই, সমস্ত রাতভোর
কোন্ কামনার আগুন ছুঁয়ে স্বপ্ন দেখি তোর,
কোন্ দুরাশার, রঙ্গিলা? তুই হঠাৎ কোনোখানে
না ভাঙলে না-দেখার দেয়াল, মিথ্যে এ তোর খোঁজে
দিন কাটানোল বাঁধন খোলার স্বপ্নে দিয়ে ছাই
ঘর ছাড়িয়ে পরিয়ে দিলি পথের বাঁধন,
তাই ব্যর্থ হল রঙ্গিলা তোর সমস্ত রঙ্গ যে।
হারে-রে রঙ্গিলা, তোর গানের টানে টানে
পার হয়েছি দুঃখ, তবু কেমন করে ভুলি
আজও আমার জীর্ণ শাখায় সুখের কুঁড়িগুলি
পাপড়ি মেলে দেয়নি, আমার শুকনো মরা গাঙে
তরঙ্গ নেই, হৃদয়ধনুর দৃপ্ত কঠিন ছিলা
দিনে দিনে শিথিল হল; রঙ্গিলা, এইবার
অন্ধকারকে ছিন্ন করে ফুলের মন্ত্র আর
ঢেউয়ের মন্ত্র শেখা আমায়, রঙ্গিলা রঙ্গিলা!
হারে-রে রঙ্গিলা, তোর সময় নিরবধি
রঙ্গও অনন্ত, আমার সময় নেই যে আর,
কে আমাকে শিখিয়ে দেবে পথের হাহাকার
কী করে হয় শান্ত, আমার প্রাণের শুকনো নদী
উজান বইবে কেমন করে, অমর্ত্য কোন্ গানে
ফুল ফুটিয়ে ব্যর্থ করি শীতের তাড়নায়,–
তুই যদি না শেখাস তবে চলব না আর, না,
রঙ্গিলা তোর কথার টানে, টানের টানে টানে।
======
অমর্ত্য গান
সাধারণ, তুমি সাধারণ, তাই
অসাধারণের গানে
উতলা হয়ো না হয়ো না, তোমার
যা কিছু স্বপ্ন সীমা টানো তার,
তুলে দাও খিল হৃদয়ে, নিখিল
বসুধার সন্ধানে
যেয়ো না, তোমার নেই অধিকার
দুর্লভ তার গানে।
সাধারণ, তুমি সাধারণ, তাই
ছোট আশা ভালবাসা—
তা-ই দিয়ে ছোট হৃদয় ভরাও,
তার বেশি যদি কিছু পেতে চাও
পাবে না, পাবে না, যাকে আজও চেনা
হল না, সর্বনাশা
সেই মায়াবীর গান ভুলে যাও,
ভুলো তার ভালবাসা।
সাধারণ, তুমি সাধারণ, তবু
অসাধারণের গানে
ভুলেছ; পুড়েছে ছোট ছোট আশা,
পুড়েছে তোমার ছোট ভালবাসা,
ছোট হাসি আর ছোট কান্নার
সব স্মৃতি সেই প্রাণে
বুঝি মুছে যায় যে-প্রাণ হারায়
সেই অমর্ত্য গানে।
======
অমানুষ
শিম্পাঞ্জি, তোমাকে আজ বড় বেশি বিমর্ষ দেখলুম
চিড়িয়াখানায়। তুমি ঝিলের কিনারে।
দারুণ দুঃখিতভাবে বসে ছিলে। তুমি
একবারও উঠলে না এসে লোহার দোলনায়;
চাঁপাকলা, বাদাম, কাবলি-ছোলা–সবকিছু
উপেক্ষিত ছড়ানো রইল। তুমি ফিরেও দেখলে না।
দুঃখী মানুষের মতো হাঁটুর ভিতরে মাথা গুঁজে
ঝিলের কিনারে শুধু বসে রইলে একা।
শিম্পাঞ্জি, তোমাকে কেন এত বেশি বিমর্ষ দেখলুম?
কী দুঃখ তোমার? তুমি মানুষের মতো
হতে গিয়ে লক্ষ-লক্ষ বছরের সিঁড়ি
ভেঙে এসেছিলে, তুমি মাত্রই কয়েকটা সিঁড়ি টপকাবার ভুলে
মানুষ হওনি। এই দুঃখে তুমি ঝিলের কিনারে
বসে ছিলে নাকি?
শিম্পাঞ্জি, তোমাকে আজ বড় বেশি দুঃখিত দেখলুম।
প্রায় হয়েছিলে, তবু সম্পূর্ণ মানুষ
হওনি, হয়তো সেই দুঃখে তুমি আজ
দোলনায় উঠলে না; তুমি ছেলেবুড়ো দর্শক মজিয়ে
অর্ধমানবের মতো নানাবিধ কায়দা দেখালে না।
হয়তো দেখনি তুমি, কিংবা দেখেছিলে,
দর্শকেরা পুরোপুরি বাঁদুরে কায়দায়
তোমাকে টিট্কিরি দিয়ে বাঘের খাঁচার দিকে চলে গেল।
======
অন্তিম শ্রাবণসন্ধ্যা
বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে জলের গন্ধ রয়েছে এখনও।
আকাশের ভাবগতিক দেখে মনে হয়,
খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে সে আবার কাজে লেগে যাবে।
পাখিরা তা জানে, তাই কোনো
উৎসাহ তাদেরও নেই এই মুহূর্তে ডানা ছড়াবার।
দিকচিহ্নহীন
যে-বিশ্বে রঙের স্পর্শ এতক্ষণ কোথাও ছিল না,
মেঘের আড়াল থেকে সূর্যদেব বিদায়ের ক্ষণে
সেখানে সামান্য রঙ ছড়িয়ে দিলেন।
জানালায় বসে দেখি শেষ হল আরও একটি দিন
অন্তিম শ্রাবণে।
======
অন্নদাস
ভাঙো হাঁটু, দাঁতের ভিতর ধরো ঘাস
অন্নদাস,
এই তোমার খুলেছে চেহারা।
কারা
ঢাক-পিটিয়ে ঢাক-পিটিয়ে ঢাক-পিটিয়ে জঙ্গলের ভূমি
কাঁপাচ্ছে দুপুরে, তুমি
জানো।
আসলে ব্যাপারটা খুবই চমৎকার কৌশলে সাজানো।
কাঁটা
দিয়ে কাঁটা তুলবার খেলাটা
কে না জানে?
হাতিও হাতিকে টেনে আনে।
অন্নদাস,
ভাঙো হাঁটু, দাঁতের ভিতরে ধরে ঘাস।
======
অমলাকান্তি
অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
======
অল্প-একটু আকাশ
অতঃপর সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
জুঁইয়ের গন্ধে বাতাস যেখানে মন্থর হয়ে আছে;
এবং রেলিংয়ে ভর দিয়ে,
সেখান থেকে অল্প-একটু আকাশ দেখা যায়।
আকাশ!
এতক্ষণে তার মনে পড়ল,
সারাটা সকাল, সারাটা বিকেল আর সন্ধ্যা
কাজের পাথরে মাথা ঠুকতে-ঠুকতে, মাথা ঠুকতে-ঠুকতে
মাথা ঠোকাই তার সার হয়েছে।
কোনো-কিছুই সে শুনতে পায়নি;
না একটা গান, না একটু হাসি।
এখন শুনবে।
কোনো-কিছুই সে দেখতে পায়নি;
আন একটা ফুল, না একটু আকাশ।
এখন দেখবে।
রুগ্ণ স্ত্রীকে মেজার-গ্লাসো-মাপা ওষুধ খাইয়ে,
কুঁচকে-যাওয়া বালিশটাকে গুছিয়ে রেখে,
ঘুমন্ত ছেলের ইজেরের দড়িটাকে আর-একটু আলগা করে দিয়ে,
সে তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
======
অন্ধের সমাজে একা
রাস্তার দুইধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে অন্ধ সেনাদল;
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই
প্রধান সড়ক। দেখি, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরের প্রেম পায়, বন্দুকের কুঁদার উপরে
কেটে বসে কঠিন আঙুল।
যে-কোনো মুহূর্তে ঘোর মারামারি হতে পারে, তবু
অস্ত্রগুলি উল্টানো রয়েছে আপাতত।
পরস্পরের দিকে পিঠ দিয়ে সকলে এখন
সম্মান রচনা করে। আমি দেখি,
অযুত নিযুত অন্ধ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে রাস্তার উপরে।
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই।
আমি সেনাপতি। আমি সৈন্য-পরিদর্শনে এসেছি।
কিন্তু তার সেনাপতি, কাহাকে সমরে নেব, কিছুই জানি না।
আমি শুধু দেখতে পাই, দশ লক্ষ যোদ্ধার সভায়
কাহারও কপালে অক্ষিতারকার শোভা নেই;
কপালে গভীর দুই গর্ত নিয়ে সবাই দাম্ভিক দাঁড়িয়েছে।
আমি একা দেখতে পাই, আমি একা দেখতে পাই, আমি
দশ লক্ষ যুযুধান অন্ধের সভায় আজ একা।
অথচ অন্ধের দেশে একা চক্ষুষ্মান হওয়া খুব ভয়াবহ।
প্রধান সড়কে তাই সৈন্য-পরিদর্শনের কালে
বারবার চমকে উঠি। মনে হয়,
অন্ধের সমাজে একা চক্ষুষ্মান হবার অধিক
বিড়ম্বনা কিছু নেই, কখনও ছিল না।
রাস্তার দুই ধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে যুদ্ধে সমুৎসুক
অন্ধ সেনাদল।
আমি হেঁটে যাই। আমি হেঁটে যেতে-যেতে
গুরুবন্ধনার ছলে দেখে যাই, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরে হতেছে সেঁকা, বন্দুকের কুঁদার উপরে
কেটে বসে কঠিন আঙুল।
আপাতত রণাঙ্গন নিস্তব্ধ যদিও,
আমি তবু বুঝতে পারি, নিকুম্ভিলা যজ্ঞের আগুনে
সর্বত্র ভীষণ ধুমধাড়াক্কার উদ্যোগ চলেছে।
আমি সেনাপতি। আমি প্রধান সড়ড়ে হেঁটে যাই।
অথচ কখন যুদ্ধ শুরু হবে, কার যুদ্ধ, কিছুই জানি না।
কাহাকে সমরে নেব, কিছুই জানি না!
(আমি কার সেনাপতি, আমি কার সেনাপতি) আমি
অন্ধের সমাজে একা চক্ষুষ্মান হবার বিপদ
টের পেতে-পেতে আজ গুরুবন্দনার ছলে ভাবি,
এবার পালানো ভাল দৌড়িয়ে। নতুবা
যদি ভীমরবে সেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়, তবে–
যেহেতু নিদানকালে চক্ষুলজ্জা ভয়াবহ, তাই–
নিজের চক্ষুকে হয়তো নিজেরই নখরাঘাতে উপড়ে ফেলে দিয়ে
অন্ধের সমাজে আজ মিশে যেতে হবে।
=======
অরণ্য বাংলোয় রাত্রি
নাকারা নাকারা কারা কারা…
ঘুমের গহ্বর থেকে মধ্যরাতে জেগে উঠল পাড়া
অরণ্যের অন্দর-মহলে।
আকাশ নির্মল নয়, কিছু জ্যোৎস্না ছড়াবার ছলে
জলেস্থলে চতুর্গুণ রহস্য ছড়ায়
হলুদ বর্ণের চাঁদ। কে যায়, কে মধ্যরাতে
দ্রুত হাতে
বিপদের সংকেত বাজিয়ে দিয়ে চলে যায়?
সমগ্র সত্তায় খেয়ে নাড়া
উৎকর্ণ অরণ্য শোনে : নাকারা নাকারা কারা কারা…
কিসের বিপদ? আজও অগ্নির বলয় দেখে হটে যেতে যেতে
পর্বতসানুর ভুট্টাক্ষেতে
ফিরে এসেছিল নাকি হাতির দঙ্গল?
অথবা ঝরনার জল
খেতে এসেছিল ধূর্তবাঘ?
জ্যোৎস্না ও আঁধার ষড়যন্ত্র করে ফুটিয়েছে হল্দে-কালো দাগ
বাংলোর উঠোনে। রাংচিতের জানলায়
একবার দাঁড়িয়ে ফের ক্ষিপ্র পায়ে কারা নেমে যায়
নীচের জঙ্গলে? সারা
অরণ্যের চিত্তে বাজে : নাকারা নাকারা কারা কারা…
কিছু কি জানাচ্ছে কেউ? কী জানাচ্ছে? পালাও-পালাও…
শত্রু আসছে, সরে যাও–
এই কথা? ধূমল আকাশে
কুয়াশায় আচ্ছন্ন সমুদ্রজলে ভাসে
হলুদ বর্ণের চাঁদ! খাদের স্যাঁতস্যাঁতে মাটি, পচা ঘাসপাতার জঞ্জাল
পায়ের তলায় চেপে দীর্ঘ শাল
দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থির অন্ধকারে। হান্টিং পয়েন্ট থেকে দেখা যায়,
চল্লিশ মেইল দূরে নিয়নের প্রগল্ভ ঝঞ্চায়
হাসছে কিরিবুরু, বিশ্বকর্মার শহর।
কিছু স্তব্ধতার পরে বাতাসে আবার শুকনো ডালপালার স্বর
জেগে ওঠে। আবার ঝরনার জলধারা
খাদের ভিতরে বুনো খরগোশের পিপাশা মেটায়।
জানি না কে এসেছিল, স্বপ্নের ভিতরে শুধু দোলা দিয়ে যায়
নাকারা নাকারা কারা কারা…
======
0 Comments