Ad Code

Responsive Advertisement

বুক রিভিইউ: দেয়াল - হুমায়ূন আহমেদ

বইয়ের নামঃ দেয়াল
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
ভাষাঃ বাংলা
ঘরনাঃ ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক উপন্যাস
বইয়ের পৃষ্ঠাঃ ১৯৮
মূল্যঃ ৩২৩ টাকা
প্রকাশনীঃ অন্যপ্রকাশ
ব্যক্তিগত অনুযোগ (রেটিং): ৪/৫
বইটি ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুুন

“মানুষ ও পশু শুধু যে বন্ধু খোঁজে তা না, তারা প্রভুও খোঁজে,” “সবাই চোখ কান খোলা রাখে, আমি নাকও খোলা রাখি,” “মানবজাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করে!”

পুরো উপন্যাসের তিনটি বেশ ভাবগাম্ভীর্যপূরক শব্দগুচ্ছ, যেখানে মানবসত্তার, ব্যক্তিসত্তার প্রাচীন রূপ, চরিত্রের দৃশ্যপট বাস্তবে রূপ পেয়েছে। আর, এটিকে বাস্তবতায় রূপ দিয়েছেন জনপ্রিয় লেখক ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
তবে, এই বইটি, দেয়াল, দেশের ক্ষমতার মসনদে থাকা ব্যক্তিদের লাল কলমের আঁচড় খেয়ে নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়েছে।
বইয়ের শুরু......
‘ভাদ্র মাসের সন্ধা। আকাশে মেঘ আছে। লালচে রঙের মেঘ। যে মেঘে বৃষ্টি হয় না, তবে দেকায় অপূর্ব। এই গাঢ় লাল, এই হালকা হলুদ, আবার চোখের নিমিষে লালের সঙ্গে খয়েরি মিশে সম্পূর্ণ অন্য রঙ। রঙের খেলা যিনি খেলছেন মনে হয় তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।’ এভাবে সূচনা ঘটেছে হুমায়ূন আহমেদের চার দশকের বর্ণময় লেখকজীবনের শেষ উপন্যাস ‘দেয়াল’- এর।
উপন্যাসের শুরুতে আকাশের রঙবদলের খেয়ায় যে সিদ্ধান্তহীনতার কথা বলা হচ্ছে তা বিশেষ ইঙ্গিতবহ। যে সময়কে উপজীব্য করা হয়েছে ‘দেয়াল’-এ, তা একটি সদ্যস্বাধীন জাতির ভাগ্যকাশের চরম অনিশ্চয়তার কাল। লেখক যেহেতু উপন্যাস লিখেছেন, তাই আছে কিছু কাল্পনিক চরিত্র। গল্প আবর্তিত হয়েছে এদের ঘিরেও।
নানা ঘটনার ঘনঘটায় ঢাকা পড়ে নি জীবনসৌন্দর্য আর জীবন-সত্যের সন্ধান। ইতিহাসের সত্য আর লেখকের সৃজনী ভাবন্য-দুইয়ে মিলে ‘দেয়াল’ পরিণত হয়েছে একটি হৃদয়গ্রাহী উপাখ্যানে।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এসব শোকাবহ পর্বের বর্ণনায় যে-পরিসর ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল, বইতে তা দেওয়া হয় নি। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে অনুবস্ত্রের অভাব এবং রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার ও তাদের প্রতি সর্বসাধারণের ক্ষোভ ও ঘৃণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শেখ মুজিবকে বঙ্গপিতা, মহামানব ও বঙ্গবন্ধু বলা হলেও মৃত্যুতে তিনি লেখকের অতটা সহানুভূতি লাভ করেননি যতটা পেয়েছেন তাঁর পরিবারের শিশু ও নারীরা।
অবন্তির গৃহশিক্ষক শফিক, যে নিজেকে খুবই ভীতু বলে পরিচয় দেয়, সে-কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’ চলে স্লোগান দেয়, গ্রেপ্তার হয় এবং নিপীড়ন সহ্য করে। খন্দকার মোশতাককে এ-বইতে সঠিক চরিত্ররূপে অঙ্কন করা হয়েছে।
‘অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম খালেদ মোশাররফ’ এবং ‘মহাবীর কর্নেল তাহেরে’র প্রতি লেখকের শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে এবং উপন্যাসে কর্নেল তাহেররকেও দেখিইয়েছেন খালেদ মোশাররফের সাহসিকতা ও চরিত্রগুণের প্রশংসা করতে!
জিয়াউর রহমানের আর্থিক সততার প্রশংসা আছে, জনগণের শ্রদ্ধা তিনি অর্জন করেছিলেন, তা বলা হয়েছে, সেই সঙ্গে তাঁর ক্ষমতালোভের কথা বলা হয়েছে এবং সরকারি তথ্য উদ্বৃত করে জানানো হয়েছে যে, ১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত তাঁর গঠিত সামরিক আদালতের বিচারে ১১৪৩ জন সৈনিক ও অফিসারকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিতে হয়েছে!
অনেক মিথ্যের আড়ালে সত্য গুটিসুটি হয়ে জমে যায়, হেলে যায়, পড়ে যায়।
লেখকের মতে, এদের দীর্ঘনিশ্বাস জমা হয় চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে- সেখানে ‘জিয়া প্রাণ হারান তাঁর এক সময়ের সাথী জেনারেল মঞ্জুরের পাঠানো ঘাত বাহিনীর হাতে।’ এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে বইতে কোনো তথ্য নেই, বরঞ্চ এই হত্যাকাণ্ডের পশ্চাতে মনজুরের ‘রূপবতী স্ত্রী’র প্রলয়ংকরী স্ত্রীবুদ্ধি কাজ করে থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্র যে বলেছিলেন, ‘উপন্যাস ইতিহাস নহে’, সে কথা যথার্থ। তবে ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাসে ইতিহাসের সারসত্য অবিকৃত থাকবে বলে আশা করা হয় এবং কল্পনাপ্রসূত আখ্যানেও কার্যকারণ সম্পর্কের ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত। দেয়াল উপন্যাসের প্রথমদিকে হুমায়ূন আহমেদ নিজের উল্লেখ করেছেন প্রথম পুরুষে, শেষদিকে এসে উত্তমপুরুষে নিজের কথা সে বলে গেছে।
নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়ায় বলবো যে, পুরো বইটি লেখক কাল্পনিক চরিত্র দিয়ে লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশের ক্ষমতার মসনদে যে পরিবর্তন আসে, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ’৭১ এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, মা-বোনের উপর অসহনীয় অত্যাচার।
মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে কতটুকু বা জানি আমরা?
কতটুকু জানে বাঙালি?
তরুণ প্রজন্মের কাছে এর প্রভাব কতটুকু?
এমন কিছু প্রশ্ন আছে যাদের উত্তর কুয়াশার মত। দূর থেকে আবছা শুধু দেখা না, সেগুলোকে ধরা বা ছোঁয়া যায় না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এর মূল উপজীব্য। লেখক এখানে বঙ্গবন্ধুর শাসনামল, বাকশাল গঠন, রক্ষী বাহিনীর কার্যক্রম, হত্যা পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, জেল হত্যা, এবং এসব ঘটনায় মেজর রশীদ, মেজর ফারুক, খন্দকার মোশতাক প্রমুখের ভূমিকার স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন।
পাশাপাশি খালেদ মোশাররফের ক্যু, মেজর জিয়াউর রহমানের আটকাবস্থা, কর্নেল তাহেরের অভিযান, সেনাবাহিনীর অফিসার থেকে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা জেনারেল জিয়ার কথা, তাহেরেরে ফাঁসি, রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার শাসনামল, উনার শাসনামলে বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি আলোচনা করেছেন লেখক।
আর এই সমস্যা থেকে রক্ষা করার জন্য আলো হাতে এগিয়ে এসেছেন অনেক কবি লেখক আর গন্যমান্য ব্যক্তিরা। তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে করতে ছেয়েছেন আপন আলোয় আ্লোকিত। হুমায়ুন আহমেদ তাদের একজন। তিনি যেমন বলেছেন একাত্তরের কখা তেমনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন ১৯৭৫ এর ষড়যন্ত্র এবং রক্তঝরা নভেম্বরের কথা।
চরিত্রের খেয়ালিপনা, সংলাপের সংঘাত, ঘটনার আকস্মিকতা ও কার্যকারণহীনতা আমাদের সবসময়ে রহস্যময়তার দিকে আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়েছে, তাই বাঙালি জাত্তিসত্তায় বিশ্বাসী, সাহিত্যপ্রেমী সবাইকে দেয়াল বইটি পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি......

Post a Comment

0 Comments

Close Menu